গোধূলির আলো
গৌতম সাহা
(এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক)
বোধিসত্ত্ব সেন প্রতি শনিবার, দেশ এ থাকলে এবং অন্য বিশেষ কোনও জরুরি কাজ কিংবা সভা না থাকলে তার বালিগঞ্জ প্লেস এর ফ্ল্যাট এ পুরোনো কিছু বন্ধুবান্ধব ও বিশেষ কয়েকজন গুণমুগ্ধ ও গুণমুগ্ধাদের নিয়ে নির্ভেজাল আড্ডা দেন । সেই আড্ডায় সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি থেকে শুরু করে হাল আমলের ফিল্ম নিয়েও উচ্চস্তরীয় আলোচনা চলে । শহরের বিশেষ রেস্তোরা থেকে বিশেষ কতগুলো বাছাই করা পদ আসে পূর্বনির্ধারিত ফরমায়েশ অনুযায়ী । সাথে থাকে স্কচ । স্কচ এবং শুধুই স্কচ । নরম পানীয়ের ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার নেই বোধিসত্ত্বের । যারা উচ্চমার্গের নেশায় আহ্লাদিত হন না তাদের জন্য হরেক রকমের নরম পানীয়ের ব্যবস্থা থাকলেও, সুরার বিষয়ে ভীষণই একগুঁয়ে তিনি, এই বিশেষ আড্ডায় স্কচ ছাড়া কোনোকিছুই 'নট এলাউড'। বোধিসত্ত্ব আড্ডার মধ্যমণি, কিন্তু তিনি বলেন কম, শোনেন বেশি । আবার যখন তিনি বলতে শুরু করেন, তখন তাঁর গুণমুগ্ধেরা আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে যায় । বোধিসত্ত্বের মুখনিঃসৃত সেই বাণী অনির্বচনীয় এক সাঙ্গীতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মিশেলদিয়ে সকলকে আবিষ্ট করে রাখেন তিনি ।
আজকের শনিবাসরীয় সন্ধ্যা একটু স্বতন্ত্র, একটু স্পেশাল । আজ আড্ডা শেষ এ নৈশভোজেরও আয়োজন এখানেই । গত সপ্তাহেই যদিও এই বিষয়ে স্বীদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিলো । দেবিকা শ্রীবাস্তব, বোধিসত্ত্বের অন্যতম গুণগ্রাহী এবং পিনাকল ইন্টারন্যাশনাল এরজোনাল লিড মনোজ শ্রীবাস্তবের সহধর্মিনী, আবদার করে বসলেন,"বোধি, ইউ রকড ইয়ার, পার্টি তো বান্তা হায়"। পার্টি তো ফের সপ্তাহেই হয়, পার্টির নাম করে পার্টি মানে, আয়োজন আরো একটু দেদার, অভ্যাগতদের সংখ্যা আর একটু বেশি, এইটুকুই!
বিষয়টা তেমন কিছু নয়; বোধিসত্ত্বের লেখা "নদীর কাছাকাছি" অবলম্বনে অনিশ মৌলিকের "জাহ্নবী" এই বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে । অনিশের ঝুলিতে এসেছে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের শিরোপা, বোধিসত্ত্ব পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার এর মুকুট । এছাড়াও "জাহ্নবী" আরো দুটো পুরস্কার করায়ত্ব করেছে । খুশির খবরটা দেবিকাই প্রথম ফোন করে জানায় বোধিসত্ত্বকে । প্রভাবশালী স্বামীর কল্যাণে দিল্লির তথ্য সম্প্রচার ও সংস্কৃতি দপ্তরের অনেক খবর থাকে দেবিকার কাছে ।
বিষয়টা তেমন কিছু নয়; বোধিসত্ত্বের লেখা "নদীর কাছাকাছি" অবলম্বনে অনিশ মৌলিকের "জাহ্নবী" এই বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে । অনিশের ঝুলিতে এসেছে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের শিরোপা, বোধিসত্ত্ব পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার এর মুকুট । এছাড়াও "জাহ্নবী" আরো দুটো পুরস্কার করায়ত্ব করেছে । খুশির খবরটা দেবিকাই প্রথম ফোন করে জানায় বোধিসত্ত্বকে । প্রভাবশালী স্বামীর কল্যাণে দিল্লির তথ্য সম্প্রচার ও সংস্কৃতি দপ্তরের অনেক খবর থাকে দেবিকার কাছে ।
জীবনের প্রথম ভাগে যখন বোধিসত্ত্ব প্রকাশকদের
দরজায় দরজায় ঘুরছেন তার কবিতার পাণ্ডুলিপিকে কাঁধের শান্তিনিকেতনী ব্যাগে নিয়ে সেই
সময়ে যাঁরা তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অমলেন্দু ও জ্যোতিষ আজও তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু
। অমলেন্দু বলতেন, "বোধি, দেখবি একদিন তুই এই
বাংলা সাহিত্য জগতের মধ্যমণি হবি, তোর এক একটা কবিতা পাবার
জন্য পত্রিকা সম্পাদক রা হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে । তোর কবিতার সংকলন দেশ বিদেশ এ পাওয়া যাবে"। অমলেন্দুর কথা মিথ্যা হয়নি । সুনীল, সমরেশ পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যের বহমানতা
কে পাঠকগণ বোধিসত্ত্বের কাঁধে চাপিয়ে পরম নিশ্চিন্তে আছেন । কবিতা দিয়ে যার
সাহিত্যের জগতে প্রবেশ তাঁর হাতে গল্প এবং উপন্যাসও বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যকে এক
অনন্য স্তরে উত্তীর্ণ করেছে ।
অমলেন্দু ও জ্যোতিষ ছিলেন বোধিসত্ত্বের
কলেজ কালের বন্ধু । বিখ্যাত ব্যারিস্টার বিমলেন্দু গঙ্গোপাধ্যায় এর পুত্র অমলেন্দু
পরবর্তীকালে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার বড় পদে চাকরি করতেন । আর জ্যোতিষদের ছিল বিরাট পারিবারিক গয়নার
ব্যবসা । গোবরডাঙ্গার ছেলে বোধিসত্ত্ব যখন দারিদ্রের জ্বালায় একদিন
পণ করলেন যে আর কোনোদিন কলম ধরবেন না, সেদিন তাঁর অভিন্নহৃদয় সুহৃদ এই জ্যোতিষই বলেছিলেন,
"তুই লিখবি, আর লেখার জন্যই তোর জন্ম
। তাতে যদি তোর এক কপি বইও না বিক্রি হয় তাও, লেখা তুই থামাবি না । তোর আর কাকিমার
ভাত কাপড়ের অভাব হবেনা কোনোদিন, আমি কথা দিলাম ।" কথা রেখেছিলেন
জ্যোতিষ ।
এই দুজন বোধিসত্ত্বের শুধু বন্ধুই নন, তাঁর লেখার প্রধান সমালোচকও। শনিবাসরীয় এই
আড্ডায় আজও আসেন তাঁরা । তবে তিনজনের নিভৃতে প্রাণের কথা হয় খুব কম। বোধি ব্যস্ত লেখা
নিয়ে । বাকি সময় সবসময় ই ভীড় । কয়েক দশক আগে তিনি লিখে যেতেন পাগলের
মতো, ঘন্টার পর ঘন্টা,
প্রাণের তাগিদে । একটা লেখা শেষ করেই ওদের বলতেন, "দেখতো জ্যোতি, কেমন লাগছে তোর"। এমন দিনও গেছে, অমলেন্দুকে ডেকে কবিতা শোনাচ্ছেন তিনি,
পড়তে পড়তে থেমে গেলেন, একটানে খাতা থেকে
পাতা ছিঁড়ে হাতে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেললেন ঘরের কোনায়, স্বগতোক্তির
স্বরে বলে উঠলেন, "কিস্সু হয়নি, ফালতু লেখা" । অমলেন্দু 'হা হা' করে উঠে
বলতেন, "একি করলি তুই?!"
চার বছর আগে এ'রকম ছেঁড়া পাতার কবিতার একটা সংকলন বেরিয়েছিল
জেনিথ পাবলিশার্স থেকে । অমলেন্দু একটা পাতাও ফেলেন নি, লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন নিজের জিম্মায়
। "আগুন ও ছেঁড়াপাতা"
সে'বছর সাহিত্যরত্নাকর পুরস্কার পায় আর
দু'বছর ধরে তা "বেস্টসেলার"
ছিল ।
***********
মনটা বিষাক্ত হয়ে গেছে বোধিসত্ত্বের । তিনি স্বপ্নেও
ভাবেননি, তাঁর প্রাণের বন্ধু
তাঁর সাফল্যের উদযাপনের দিনে এইভাবে আঘাত করে যাবে তাঁকে! যে ফুরফুরে মেজাজে পার্টি শেষ করেছিলেন, সেখান
থেকে তাঁর মনের অবস্থান যে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে যাবে তাঁরই বন্ধু এটা
তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি ।
অথচ আজকের পার্টিতে অন্য মাত্রা যোগ করেছিল
অনিশ । সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও এই ফ্ল্যাট এ ঢুকলো মিস্টার ঝুনঝুনওয়ালা
কে নিয়ে । পবন ঝুনঝুনওয়ালা ওর "জাহ্নবী"র প্রোডিউসার
। ঝুনঝুনওয়ালা আপ্লুত । পরবর্তী ফিল্মের অগ্রিম কন্ট্রাক্ট নিয়ে
তো নিভৃতে আলোচনা সেরে রাখলেনই, উপরন্তু বোধিসত্বকে আগের থেকে কত বেশি পেমেন্ট করবেন সেই ব্যাপারেও একটা
প্রাথমিক ধারণা দিয়ে গেলেন । সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যেটা হল তা হল যখন
তিনি সবার অনুরোধে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে "পুরানো সেই দিনের কথা" শোনালেন ! এতো বড় বিজনেসম্যান এর বাংলা ভাষার
প্রতি এই প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে সত্যি উচ্ছসিত হয়েছিল উপস্থিত সকলে । সবাইকে বিদায়
জানিয়ে ফ্ল্যাট এ ঢুকে দেখলেন অমলেন্দু তখনও যায়নি, সোফার উপর বসে । সামনে গ্লাসের
পানীয় প্রায় তলানিতে। বোধিসত্বকে ঘরে ঢুকতে দেখে বলে উঠলেন, "এবার আমি চলবো বোধি, ইট ওয়াজ আ নাইস পার্টি ডিয়ার "।
পা টলে গেলো অমলেন্দুর । পড়ে যেতে যেতে
নিজেকে সামলে নিলেন তিনি ।
-" চল আমি তোকে
তোর গাড়ি অবধি ছেড়ে দিয়ে আসি "।
-" ছাড়বি?
কোথায় ছাড়বি? ধরলি কোথায় যে ছাড়বি
!"
-" নেশা হয়ে গেছে
তোর অমু । "
-" নেশা!
আমার? ফাক অফ ! অমলেন্দু গাঙ্গুলির এত সহজে নেশা হয়না । " বলে টলতে টলতে ফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগোলেন অমলেন্দু । সত্যিই বোধিসত্ত্ব
অবাক হলেন, অমলেন্দুকে কোনোদিন
সামান্য বেসামাল হতে তিনি দেখেন নি । অনেক বছর আগে শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিন
বন্ধুতে বোতল এর পর বোতল একনাগাড়ে বিয়ার খেয়ে ছিলেন, আর শেষে যখন বোধিসত্ত্ব নেশার ঘোরে রাস্তাতেই
শুয়ে পড়েছেন এই অমুই কাঁধে করে তাঁকে তুলে নিয়ে হোটেল এ ফিরেছিলেন ।
দরজার কাছে পৌঁছে অমলেন্দু ঘুরে দাঁড়ালেন
। "তোকে একটা কথা বলি বোধি", থামলেন তিনি একটু, আবার বললেন, " আগের মতন লিখতে পারিসনা তুই আর । তোর লেখা পড়ে আগের মতন কাঁদতে পারিনা
আমি " ।
এটুকু বলে ডোর ল্যাশ টা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেলেন অমলেন্দু ।
***************
রাত দুটো বাজে । বোধিসত্ত্ব জেগে আছেন, অমলেন্দু চলে যাবার পর পরপর চারটে লার্জ
নিয়েছেন, তবুও বুকের জ্বালা কমছেনা । "অমলেন্দু শেষ অবধি জেলাসি তে ভুগছে! সারা দেশ, সারা পৃথিবী যাকে সোনার মুকুট পড়াচ্ছে
তাঁকে ও বলছে, আগের মতন লিখতে পারিসনা তুই !!! আমার প্রশংসাতে তুই ঈর্ষান্বিত বন্ধু? আমার দেশজোড়া
খ্যাতি তুই ভালমতন নিতে পারছিস না! সমাজের নামি দামি নাগরিকদের
সাথে আমার সখ্যতা তুই সহ্য করতে পারছিস না! আমি লিখতে না পারলে
এরা কোন স্বার্থে আমাকে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের সম্মান দিলো? তুই বলতে কি চাইছিস? আমার নাম দেখে! বোধিসত্ব সেন আজ একটা ব্র্যান্ড ?! নামটা না জোড়া
থাকলে আমার লেখার কোনও মূল্য নেই আজ?!"
ঘুম আসছেনা , কিছুতেই ঘুম আসছেনা, অনেকদিন পর কেতাদুরস্ত বোধিসত্ত্বের বুকের ভিতর সেই বিদ্রোহী কবি স্বত্বা
জেগে উঠলো যেন । অমলেন্দুকে প্রমান করে দিতেই হবে যে আজও এই কলম দিয়ে আগুন
ঝরে ! আজও তিনি বাংলা সাহিত্যের
অবিকল্প সম্রাট ! তিনি এক থেকে নিরানব্বই, বাকিরা ওই পড়ে থাকা এক শতাংশ । কিন্তু কি করে দেখাবেন অমলেন্দু'কে! অনেকক্ষন
অস্বস্তিতে ছটফট করেন তিনি ।
হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা আইডিয়া খেলে
গেলো মনের ভিতর । কম্পিউটার এর সুইচ অন করে ফেসবুক এ লগইন করলেন । ১০২ টা ফ্রেন্ডস
রিকোয়েস্ট ! এমনিতে তিনি সোশ্যাল
নেটওয়ার্ক এ খুব একটা সড়গড় না, কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে
চলতে গেলে একে ছাড়াও চলবেনা, তাই তিনি দ্রুত শিখে নিয়েছেন
। আর এক্ষেত্রেও তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অমলেন্দুই
। ওর আত্মীয় স্বজন, প্রফেশনাল বন্ধুবান্ধব অনেকে বিদেশ এ
থাকে । রোজ তাঁদের সাথে ওর যোগাযোগ ফেসবুক কিংবা স্কাইপে তে । এছাড়াও কিছু
ওয়েব সাহিত্যপত্রিকার সাথেও ও যুক্ত । নতুন উঠতি লেখক লেখিকারা নিজের ইচ্ছে মতন
লেখা পোস্ট করে সেখানে ।
"কি যেন নাম
? মনেও থাকেনা আজকাল ! আচ্ছা অমলেন্দুর পেজ
এ চেক করি " এই ভেবে অমলেন্দু গাঙ্গুলী র পেজ এ ক্লিক
করলেন বোধিসত্ত্ব । পেয়েও গেলেন । "ইচ্ছেডানা"! নামও বটে, অনেক কবি, সবাই গল্পকার! এই নাহলে সাহিত্য! সাহিত্য যেন হাতের মোয়া!
-সমুদ্রের দেবতারা ঝাউবনে গিয়ে ডিম্ পারে/ আকাশ থেকে পড়লো খসে গরুর মাংস , ব্যস হয়ে গেলো
কবিতা। তা পরেই লাইকস, বুড়ো আঙ্গুল আপ চিহ্ন ! অমলেন্দুও
পারে! এখানেই নাকি কয়েকজন ভালো লিখছে ! সিদ্ধার্থ রায় বলে একজনের লেখা চোখে পড়লো । পড়ে ফেললেন বোধিসত্ত্ব
।
" হুম, ঠিক আছে, কিন্তু বাবা এই এক পাতা লেখা দিয়ে কি
আর তোমাকে চেনা যাবে! কয়েক হাজার পেজ লেখো তো আগে,
আগে পরিপূর্ণ লেখক হও তারপরে দেখা যাবে । রুমা ব্যানার্জী ! মহিলা! এত মহিলা
লেখক! মহুয়া সেনগুপ্ত, কাকলি জানা,
কথিকা সান্যাল, রুবি রায়, ঈপ্সিতা বসু, শর্মিষ্ঠা দাসগুপ্ত, জয়তী গুহ ! কত লেখক! মহেশ্বর মাইতি, শামীম আনসার, অনিন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গৌতম সাহা ! সাহা ! হুমম দাঁড়িপাল্লা ছেড়ে গপ্পো লেখা!
এই দেশটার সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ভয়ানক উজ্জ্বল!" প্রত্যেকটা লেখা কিছুটা পড়লেন বোধি, তারপর মনে
মনে বললেন, "এগুলোও লেখা! এদের
কারো কারো লেখা পড়ে অমলেন্দুর চোখে জল আসে, আমার লেখা পড়ে
আসেনা !! তোকে প্রমান করবো অমলেন্দু যে আমার আগুন আমারই আছে,
তার আঁচ একটুও কমেনি । তোর পথেই তোকে প্রমান দেবো, অপেক্ষা কর । "
ইচ্ছেডানা এবং ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এলেন
বোধিসত্ত্ব । একটু ভাবলেন, চুপ করে থাকলেন একটু, আর একটা পেগ
বানালেন, আয়েশ করে তাতে সিপ্ দিয়ে মেইল খুললেন । প্রথমে ভাবলেন
কুহেলিকা মুখোপাধ্যায় । বেশ মিষ্টি কিন্তু ব্যক্তিত্বপূর্ণ নাম । কি ভেবে বললেন," নাহ, মহিলা
নয় "। অবশেষে একটা জি মেল্ একাউন্ট খুললেন বোধিসত্ব । গৌরসুন্দর বাউরি
। এই নাম এ ফেসবুক
এ একটা একাউন্ট খুলে তাতে কৃষ্ণের একটা ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসাবে আপলোড করে দিলেন
তিনি । "এইটুকু থাক, বাকিটা কাল হবে", এই ভেবে কম্পিউটার সাট ডাউন
করলেন বোধিসত্ত্ব ।
*************
ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হলো আজ বোধিসত্ত্বের।
প্রায় এগারোটা বাজে । বিছানার পাশে বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইল এ দেখলেন অনেকগুলো
মিসড কল, দেবিকার, অমলেন্দুর । তারপরে একটা এস এম এস । অমলেন্দু লিখেছে, "I am extreme।y sorry . P।ease forgive me for my ।ast night words " । পাত্তাই দিলেন
না বোধিসত্ব । চশমা টা চোখে লাগিয়ে অমলেন্দু কে ফোনে ধরলেন । বললেন, " কি সব যা তা লিখেছিস! তোকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে। বাড়িতে শীলা কে বল যে তুই আমার এখানে
খাবি । আমি সব রেডি করছি । তুই দেড়টার মধ্যে এখানে চলে যায় । আমি জ্যোতিকেও
খবর দিচ্ছি । তুই আসার সময় জ্যোতি কে তুলে নিয়ে আসবি । দেরি করবিনা একদম
। একটা জরুরি কাজ
করবো । ঠিক আছে ? রাখছি তবে ।"
অমলেন্দুর উত্তরের অপেক্ষা না করে লাইনটা
কেটেই জ্যোতি কে ধরার চেষ্টায় ওকে ফোন করলেন । ফোন "আউট অফ রিচ" বলতেই মনে
পড়লো, জ্যোতি তো নেই, সকাল ৯:১০ এর ফ্লাইট এ ওর দিল্লি যাবার কথা ছিল ।
বিছানায় শুয়েই যতীনকে চা দিতে বললেন
হাঁক পেড়ে । চা খেয়ে ওকে দুপুরের খাবার বিষয়ে ফরমায়েশ করে বাথরুমে
ঢুকলেন তিনি । ফ্রেশ হয়ে চান টান করে বেরোতে বেরোতে ১২ টা বেজে গেলো । স্নান করে আসার
পর শরীরটা আরও ঝরঝরে মনে হলো । ভাবলেন আর এক কাপ চা খাওয়া যাক । যতীনকে চা করতে
বলে বললেন, " এখন শুধু দুটো
ক্রিম ক্র্যাকার দাও, ব্রেকফাস্ট করবোনা, একেবারে লাঞ্চ । অমু একটু পরেই চলে আসবে । দেড়টার মধ্যে
হবে তো?" যতীনের মুখে
আশ্বাস বাণী শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে কম্পিউটার এর সামনে বসলেন । টেবিলের উপর রাখা
ডায়রি টায় চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন তাঁর জরুরি এপয়েন্টমেন্ট গুলো । আজকে কিছু নেই
তেমন, কাল একজন গুরুত্বপূর্ণ
পাবলিশিং সংস্থার মার্কেটিং হেড এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট সন্ধে ৭টায় এভারগ্রিন ক্লাব
এ ।
"ঠিক আছে,
দেখা যাবে" এই বলে ডায়রি বন্ধ করেই
কম্পিউটার এর সুইচ অন করলেন । নেট অন করেই সরাসরি কালকে তৈরী করা প্রোফাইল
দিয়ে ফেসবুকএ এলেন বোধি । গৌরসুন্দর বাউরি ! চমৎকার নাম হয়েছে । চা বিস্কুট শেষ
করেই একটা সিগারেট ধরিয়ে দু একটা সুখটান দিয়েই 'ইচ্ছেডানা' খুললেন । ব্যস্ততায় নতুন
লেখা পড়াই হয়না । এগুলো অধিকাংশই যদিও সব কাঁচা হাতের লেখা, তবুও যা চোখের সামনে এলো পড়া শুরু করলেন
তিনি । কতক্ষন যে পড়ে চলেছেন খেয়াল ই রইলো না তাঁর । সম্বিৎ ফিরলো
কলিং বেলের আওয়াজে ।
"কি ব্যাপার কি,
এতো জরুরি তলব?" বলতে বলতে ঘরে ঢুকেই
অমলেন্দুর চোখ আটকে গেলো ২৪ইঞ্চি স্ক্রিন এর পর্দায় ।
-"একিরে
! শরীর ঠিক আছেতো? তুই পড়ছিস
"ইচ্ছেডানা!"
কটাক্ষটা গায়েই মাখলেন না বোধি ।
-" কয়েকজন খুব
একটা খারাপ লেখেনি বুঝলি । তবে অধিকাংশই লিখেছে লিখতে ভালো লাগছে
বলে । কি লিখছি সেটা
জানে, কেন লিখছি,
কোথায় পৌঁছতে চাইছি শেষে,এই ভাবনা টা কম
। তবে কয়েকজনের লেখা ভালো লাগলো রে । যাক, চল খেয়ে নেই, যতীনের সব রেডি মনে
হয় ।"
-" সে তো বুঝলাম,
কিন্তু জরুরি তলব কেন, সেটাতো বলবি ।"
-" বলবো বলেই তো
ডাকলাম, আগে খেয়ে নি চল ।"
****************
-"তুই কি পাগল হোলি
বোধি?"
-" একদম নয়,
অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বলছি যা বলছি । তুই জানিস যে
কথার কথা বলার লোক বোধিসত্ব সেন নয়। তুই যে কথা কাল বলেছিস তার প্রমান হওয়া
দরকার । আমার জানা দরকার যে, যা লিখছি তাতে আগের মতন ঝাঁঝ আছে কিনা, নাকি বোধিসত্ত্ব সেন এর নামেই চলছে সবকিছু, ভিতরে
কি আছে সেটা লোকে পড়ছেনা, বুঝছেনা । বোধিসত্ব সেন, এই নামটাই তো লেখাগুলোর দাম লক্ষ টাকা
বানাচ্ছে, তাই এই নামটা না থাকলে, আর প্রখ্যাত লেখকের পরিচয় টা না থাকলে আমি দেখতে চাই আমার লেখা পাঠক কিভাবে
নিচ্ছে । আমি সত্যি ই জানতে চাই । আর সোশ্যাল মিডিয়া তেই এই কাজটা ভালো
হবে । আমি আর তুই ছাড়া
গৌরসুন্দর বাউরি কে কেউ জানবে না । একটা অতি সাধারণ মানুষের নামে লিখবো এখানে, দেখি গৌরসুন্দর বাউরি পাঠক মনে কোনো দাগ
কাটতে পারে কিনা । তুই সবাইকে বলে দে যে আমি কয়েকদিন এর জন্য দেরাদুন যাচ্ছি
। সামনের মাসের
৪ তারিখে দিল্লি তে পুরস্কার নিতে যাবার কথা, ঝুনঝুনওয়ালা তাই জানিয়েছে । এই ক'দিন আমি শুধু "ইচ্ছেডানা"য় লিখবো । এখানে পাঠকসংখ্যা
কয়েক হাজার । লেখেও অনেক এ । অনেক লেখার মাঝে গৌরসুন্দর বাউরি কল্কে
পাচ্ছে কিনা সেটা জানার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা হয়না ।
তোকে ডেকেছি আমাকে একটু দেখিয়ে দেবার
জন্য যে কিভাবে এখানে লেখা পোস্ট করতে হয় ।"
একটানা এতো কথা বলে থামলেন একটু বোধিসত্ত্ব
। অমলেন্দু নির্বাক
শুনছিলেন । অবাক হয়ে ভাবছিলেনও । তাঁর বন্ধুর এই খেপা রূপ টাই চেনা তাঁর
। কাল তিনি ইচ্ছে
করে খোঁচা টা দিয়েছিলেন যাতে বোধি, তাঁর এতদিন এর প্রাণের বন্ধুর আত্মগরিমা তে একটু আঘাত করতে
পারেন । একেবারে বানিয়ে বলেছিলেন তাও না । ইদানিং তাঁর লেখাতে তিনি তাঁর পুরোনো বন্ধু
কে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, এটাও সত্যি ! তবুও বললেন,
-" বোধি,
তোর কাউকে প্রমান দেবার কিছু নেই, তোর লেখনীর
ধার প্রমাণিত, তোর এই পাগলামি করার যুক্তি নেই ।"
-" আমি কাউকে কিছু
প্রমান দিচ্ছিনা, আমি শুধু নিজেকে যাচাই করতে চাই,
নিজেকে একবার আয়নায় দেখতে চাই, ব্যস এর
বেশি কিছুনা ।"
অমলেন্দু আর তর্ক করেন না, বলেন, "তুই যখন এই কথা বলছিস তখন তো আমার আর কিছু বলাই সাজেনা । ঠিক আছে, তোকে বুঝিয়ে দিচ্ছি কি ক'রে লেখা পোস্ট করে । পাশাপাশি ভুলে যাসনা, বোধিসত্ব সেন এর নামের ওজনের পাশে এক
অখ্যাত গৌরসুন্দর এর নামটা কিন্তু নেহাতই পলকা, এই অসম লড়াই
তে জেতা গৌরসুন্দর এর কাছে ভীষণ কঠিন হবে । এই খেলায় আসল বোধিসত্ত্বের কোনো ক্ষতি
যেন না হয় ।"
-" হবেনা,
কথা দিলাম । আমি শুধু বোধিসত্বের কলম টাকে পরখ করে
নিতে চাই একবার । তার বেশি কিছুনা ।"
-" তথাস্তু
!" বলে অমলেন্দু তাঁর বন্ধুকে বোঝাতে বসলেন 'ইচ্ছেডানা'র কায়দা কানুন ।
গৌরসুন্দরকে ইচ্ছেডানার সদস্য করে বললেন, "আপাতত নিজেদের ফোরামেই লেখা পোস্ট
কর । এখানে সদস্যরা কি ভাবছে তার ছবি পেয়ে যাবি ।"
এক অজানা রোমাঞ্চ অনুভব করেন বোধিসত্ব
। বলেন, "এটুকুতেই হবে আপাতত । মাথাটা জ্যাম
হয়ে গেছে, চল গঙ্গার হাওয়া খেয়ে
আসি ।"
নতুন কেনা Ciaz নিজেই চালিয়ে গঙ্গার ধারে একটা ফাঁকা
জায়গায় দাঁড় করালেন বোধিসত্ত্ব । অস্তগামী সূর্যের মায়াবী আলোর খেলা দেখতে
দেখতে মনের গভীরে খেলা চলতে লাগলো শব্দ আর ছন্দের । ভেবে ফেললেন তাঁর কবিতার প্রথম লাইন ।
ফরমায়েশি লেখা নয়, অনেকদিন পর প্রাণের টানেই লিখলেন বোধিসত্ব
। কবিতা লেখা হয়না কতদিন! আজ ভাবলেন কবিতা দিয়েই ইচ্ছেডানায় সুরুয়াত করা যাক । লিখলেন মাত্র
৮ লাইনের কবিতা, লিখে অনেকবার দেখলেন, কাটলেন বেশ কয়েকবার । অনেক জায়গায়
পরিবর্তন করলেন । নিজের মনেই হাসলেন খানিকটা । প্রকাশকরা এমন ভাবে ঘাড়ের কাছে নিঃস্বাস
নেয় যে কতদিন নিজের লেখা দ্বিতীয়বার আর পড়েন নি বোধিসত্ব! রাতের খাবার শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন,
লেখাটা কে কপি করে পেস্ট করলেন ইচ্ছেডানার পাতায় । কিছুক্ষনের মধ্যেই
কবিতা ইচ্ছেডানার পাতায় ফুটে উঠলো, approva। এর মেসেজও চলে এলো । কম্পিউটার বন্ধ করে মিউজিক প্লেয়ার এ
নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় এর মালকোষ চালিয়ে শুয়ে পড়লেন বোধিসত্ব ।
*******************
আজ পাঁচদিন হলো বোধিসত্বের কেমন একটা ঘোরের
মধ্যে কেটেছে । ফোন 'আউট অফ রিচ', বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
প্রায়, যেটুকু যোগাযোগ তা অমলেন্দুর মাধ্যমে। এদিকে দিল্লি
যাবার দিনও এগিয়ে আসছে, হাতে প্রচুর লেখা বাকি রয়েছে । প্রচুর কাজ বাকি । বাস্তবের টান
খুবই অমোঘ, এখানে রোমান্টিকতার
কোনো স্থান নেই । নিজের হয়তো পরিপূর্ণ সংসার নেই, মা চলে যাবার পর সেই শুন্যস্থান ভরাট
হয়েছিল অপর্ণার ভালোবাসায়, সাহচর্যে । সেও চলে যাবার
পর আর কখনো সংসার গড়ার কথা ভাবেন নি তিনি, ডুবে ছিলেন তার সৃষ্টিশীল জগতেই । সেই জগৎ সৃষ্টিশীলতার
হলেও ক্রমশ সেটা পেশাগত দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে । কাজ, কাজ আর কাজ । অর্থ আর কলা এই ভোগবাদী জগতে একে অপরের
সাথে জড়াজড়ি করে কখন যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তা বুঝতেই পারা যায়নি । আজ আর এর থেকে
মুক্তি নেই তাঁর । যারা তাঁকে পর্বতের চূড়া ভেবে তাঁর জায়গায় পৌঁছতে চাইছে
তাদের কেউ যদি কখনো এই চূড়ায় উঠতে পারে তখন বুঝবে যে চূড়ায় ওঠাটা কষ্টকর, কিন্তু আরো কষ্টকর এই চূড়া থেকে নামতে
না পারা, নামতে না চাওয়া । এ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব !
এই পাঁচদিনে 'ইচ্ছেডানা' তে
তাঁর ৬ টা লেখা প্রকাশিত হয়েছে । প্রথম কবিতা তে লাইক পড়েছিল ১৭টা । প্রথমে খুব অবাক
হয়েছিলেন তিনি । সাধারণ একটা প্রেমের কবিতায় যেখানে অগুনতি লাইক আর কমেন্টস
এর বন্যা বয়ে গেছে সেখানে বোধিসত্ত্ব সেন এর কবিতায় মাত্র ১৭ টা লাইক! পরে অমলেন্দু বুঝিয়ে বলেন তাঁকে,
"বন্ধু, এটা এমন ই হবার কথা!
দিন যত যাবে ততো সদস্যরা পড়বে তোর লেখা, স্বাভাবিক লাইকস এর বাইরেও কিছু পাঠক পাঠিকার হয়তো নির্দিষ্ট করে তোর লেখা
ভালো লাগবে, যারা সিরিয়াস লেখার স্টাইল এর সাথে পরিচিত তারা
গৌরসুন্দর বারুই নামের আড়ালে একজন উচ্চমানের লেখক কে আবিষ্কার করবে ক্রমশ । "
তাই ই হয়েছে । ছয় নম্বর লেখাটা বোধিসত্ত্ব লিখেছিলেন
একজন উভকামী নারীকে নিয়ে । তাঁর শরীর, মন, প্রেম,
নিষ্ঠুরতা, নির্লিপ্ততা, কখনো কাউকে পাবার উদগ্র বাসনা এইসব নিয়ে দীর্ঘ স্টাডি করেছিলেন তিনি । সেই স্টাডির বিষয়গুলোকে
পরতে পরতে মিশিয়ে লিখলেন, "পক্ষকাল" । লাইক বা ভালোবাসা চিহ্ন পড়লো ২৩০ টা!
"ভালো",
"বেশ ভালো", "বেশ অন্য রকম,
কিন্তু ভালো" এইরকম গোছের কমেন্টস এসেছে
প্রায় খান পঁচিশেক ।
ঈপ্সিতা নাম এরএকজনের কমেন্টস বেশ চিত্তাকর্ষক
। তিনি লিখেছেন, "একজন এমন নারীর মনের ভিতর প্রবেশ
করে তাকে উপস্থাপিত করলেন যে মশাই ! hats অফ
!"
মহেশ্বর মাইতি বলে একজন লিখলেন, "লেখকের বিষয় নির্বাচন কে সাধুবাদ
জানাই । আরো লিখুন, লিখতে থাকুন ।"
জয়িতা নামে একজন লিখলেন, "লেখকের লেখায় বোধিসত্ত্ব সেন এর
ছোঁয়া পেলাম যেন! বিষয়টি অনবদ্য উপস্থাপিত করেছেন গৌরসুন্দর
বাবু । পরবর্তী লেখার আশায় রইলাম । একটা কথা না বলে পারছিনা । কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত
হতেই পারেন, কিন্তু সেই প্রভাবকে
কিন্তু লেখককেই কাটিয়ে উঠতে হয় । আশাকরি এই মতামতকে উপদেশ হিসাবে নেবেন
না । শুভেচ্ছা রইলো
আগামী লেখার জন্য ।"
খুব হাসলেন বোধিসত্ত্ব । বন্ধু অমলেন্দুর
কথায়, কিংবা নেশার ঘোরে যে
কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন তা যেন এই পাঁচদিনে অনেকখানি স্তিমিত হয়ে এসেছে
। আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন তিনি যে, বোধিসত্ব সেন এর মতন আগুন হয়তো অনেকেরই
আছে,কিন্তু তাহলেই যে তিনি তাঁর মতন খ্যাতি পাবেন,
প্রচার পাবেন তা নাও হতে পারে । আজ যদি তাকে প্রথম থেকে শুরু করতে বলা
হয়, হয়তো আজকের অবস্থানে
তিনি কোনোদিন পৌঁছতে পারবেন না । তাঁর সেই আগুন যে স্বতন্ত্র তা বোঝাতে
তাঁর লেখা পাঠককে পড়তে তো হবে! কিন্তু পয়সা দিয়ে কিনে মানুষ গৌরসুন্দরের লেখা পড়বেনা, তার চেয়ে নিকৃষ্ট মানের লেখা বোধিসত্ত্ব সেন এর একটা গল্পের বই ৩০০ টাকা
দিয়ে কিনে ড্রয়িং রুমে বইয়ের সুসজ্জিত সেলফ এ সাজিয়ে রাখবে । অমলেন্দুর উপর
কৃতজ্ঞ হন তিনি । সত্যিটাকে উপলব্ধির স্তরে নিয়ে আসার জন্য ।
আবার মনে মনে ভাবেন, "ক্লাস বলেও একটা ব্যাপার থাকে,
সুপারলেটিভ কথা টা তাহলে ইংলিশ এ থাকতোনা । তবে বর্তমান যুগে
সেই ক্লাস এর কদর কমে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত । এই ক্লাসটা আছে, থাকবে । পাঠক, দর্শক, শ্রোতা, গুণমুগ্ধের মানের উপর লেখক, শিল্পী, গায়কের ক্লাস নির্ভর করেনা, এটা স্বতন্ত্র,
এটা সৃষ্টিশীল ব্যক্তির নিজস্ব । হয় তা জন্মগত, কারো কারো ক্ষেত্রে তা বহু কালের একনিষ্ঠ,
অক্লান্ত সাধনার ফল । একে অস্বীকার করে কার সাধ্য।"
গল্পের প্লট যেন ছলকে উঠলো বোধিসত্ত্বের
মাথায় ।
মনে মনে ভাবেন, খেলাটা এবার গুটিয়ে আনতে হবে । অনেক কাজ বাকি
। অনেকদিন আগে নীলাক্ষ
গুপ্তের লেখাতে উস্তাদ আফতাব হুসেন খান এর জীবনকাহিনী পড়েছিলেন, একদম বালক বয়েস এ পিতৃহারা হয়েও মামা
চাচাদের কাছে সেতার শিক্ষা করেছিলেন বিস্ময় বালক আফতাব । যন্ত্রসংগীত শিল্পী
হয়েও তার হাতে সেতার গান গেয়ে উঠতো । বলা যায়, যন্ত্রসংগীত এ তিনিই প্রচলন করলেন এই
স্টাইল- গায়কী অঙ্গ । হয়ে উঠলেন ভারতবর্ষের শাস্ত্রীয় সংগীত
জগতের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ । বোধিসত্ব ভেবে নিলেন, এই গল্প দিয়েই ইচ্ছেডানা পর্ব শেষ করবেন
তিনি । অমলেন্দু কে ফোন করে বললেন, "আর সময় নেই বুঝলি অমু,
প্রচুর কাজ বাকি পড়ে গেছে রে । সবগুলো কে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিতে হবে
দিল্লি যাবার আগে । তবে নিজের খেয়ালে বেছে নেওয়া এই ইচ্ছেডানা পর্বটা জীবনের
একটা স্মরণীয় অধ্যায় হয়েই থাকবে আমার কাছে ।"
অমলেন্দু রসিকতা করলেন, "ইচ্ছেডানার পাঠকরা কি সত্যি টা
জানবেনা?" ছোট্ট করে হাসলেন বোধিসত্ত্ব, বললেন, "দেখা যাক, আপাতত আমার মাথায় ভীমপলশ্রী ছাড়া কিছু নেই ।"
অমলেন্দুও হাসলেন, "পাগল, এই না হলে তুই বোধিসত্ব!"
********************
শেষ গল্প লিখলেন বোধিসত্ত্ব, ইচ্ছেডানার পাতায় । দীর্ঘ গল্পের
শেষটা করলেন এইভাবে -
"তিলধারণের জায়গা
নেই মহাজাতি সদন প্রেক্ষাগৃহে । সংগীত পিপাসু শ্রোত্রী মন্ডলীর ভিড় প্রেক্ষাগৃহ
ছাড়িয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ অবধি চলে এসেছে । স্বাভাবিক ! প্রায় এক দশক পরে সেতার সম্রাট উস্তাদ
আফতাব হুসেন খান বাজাবেন কলকাতায় । কলকাতা, যেখানে তাবড় তাবড় শিল্পী তাঁদের শিক্ষা, তালিম, তৈয়ারি কে উজাড় করে দেবার জন্য উদগ্রীব
হয়ে থাকেন, এই সেই কলকাতা, যেখানে
শ্রোতা দর্শকদের স্বীকৃতি মানে সারা দেশ তাঁর নাম জয়ধ্বনি করবে । সংগীতের এই তীর্থভূমিতে
জীবনের এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত কাটিয়েছেন উস্তাদ আফতাব হুসেন । কিন্তু শিল্পী
মনের অভিমান ও আরো অনেক কারণে এই দ্বিতীয় ঘর এর শহরে পা রাখেন নি আফতাব অনেক বছর । এই বৃদ্ধ বয়সেও
সারা দেশ বিদেশ যিনি চষে বেড়ান তাঁর সেতার নিয়ে তিনি আজ দশ বছর পর কলকাতা এসেছেন
তাঁর একনিষ্ঠ সাগির্দ এর বহুদিনের নাছোড় অনুরোধ উপরোধের পর । স্বভাবতই সংগীত মহলে এক তীব্র ঔৎসুক্য , দ্বিপ্রাহরিক অনুষ্ঠান! কি বাজান উস্তাদজী, কি বলেন ! কয়েকদিন আগেই শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন প্রখ্যাত বোদ্ধা ও সমালোচক একটা
সর্বভারতীয় পত্রিকায় লিখেছেন, "আজকের উস্তাদ আফতাব
হুসেন তাঁর সোনালী দিনের মৃদু ছায়ামাত্র । সঙ্গীতানুরাগী গুণীজন তাঁর সেতারের মূর্ছনা
শুনতে যান, কিন্তু উস্তাদজি এখন
আর সেতারটাই ভালো করে বাজান না, বাজাতে বসে তিনি গান গাইবেন,
ঠুংরির দু একটি চাল শুনাবেন, শ্রোতাদের মন
তাতে ভরেনা । এইকারণে সেতার ও তাঁর হাতে আগের মতন আবেশ তৈরী করতে পারে
না ।" লেখাটির হেডিং ছিল, "Ustad Aftab Khan
- a setting Sun " । সমালোচনা কি উস্তাদজীর কানে পৌঁছায়নি ? পদ্মবিভূষণ পুরস্কারকে যিনি উন্নাসিকতায়
প্রত্যাখ্যান করেন তিনি কি কিছু বলবেন না? নাকি সত্যি ই জবাব
দেবার উপায় নেই আর বৃদ্ধ আফতাব হুসেন এর ।!
প্রথাগত ঘোষণা, সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর মঞ্চে উঠলেন উস্তাদ
আফতাব হুসেন । ঝলমলে, চোখ ঝলসে যাবার মতন সোনালী কাজ করা কালো মখমলের মতন পাঞ্জাবি, সাদা আলিগরি পাজামা, বুকের কাছে শোভা দিচ্ছে রত্ন
খচিত দুটি সোনার হার, হাতের অনামিকায় বড় মটর দানার সাইজের
হিরে খচিত সোনার আংটি । সম্বর্ধনা, মাল্যদান ইত্যাদি পর্ব শেষ হলে পর সামনে
শোয়ানো সেতার টাকে তুলে পরম যত্নে তারগুলোকে আর একবার সূক্ষতায় বেঁধে নিলেন তিনি
। উপচে পড়া মহাজাতি সদনের ভীড় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষারত, উস্তাদজী কি বলেন, এত্তদিন পর কলকাতায় এসে কিছুতো বলবেনই তিনি । ঘোর কাটে সবার
সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ উস্তাদ আফতাব হুসেন এর বাদশাহী স্বর এ । " ম্যায় আজ ভীমপলাশ বাজাউঙ্গা "।
এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস ! উস্তাদজীর মুখ দিয়ে কোনো কথা নেই!
নেই তাঁর ঘরানা, তাঁর নির্দিষ্ট বাজ নিয়ে
আলোচনা, নেই কোনো কটাক্ষ! এমনকি সমালোচনার
প্রতুত্তরে নেই কোনো সমালোচনাও ! এই কি সেই আত্মগরিমায় ভাস্বর
পরিচিত উস্তাদজী? ধাঁধা লেগে যায় সমবেত দর্শকমণ্ডলীর মনে!
কোনো গান গাওয়া নয়, কোনো মন্তব্য নয়, সেতারেই দুই ঘন্টার আলাপ, জোড়, ঝালার পর মন্দ্র থেকে তার সপ্তক এ শেষ হওয়া এক তেহাই এর মাধ্যমে কলকাতাকে
ভীমপলশ্রী চিনিয়ে তাঁর যন্ত্রকে মাথায় ঠেকিয়ে সামনে শোয়ালেন উস্তাদ আফতাব হুসেন
খান । মহাজাতি সদনের পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ যেন বিহ্বল , ঘোরের মধ্যে ! বাজনা থেমেছে প্রায় তিন মিনিট অতিক্রান্ত, তবু
কেউ কোনো কথা বলতে পারছেনা । হাততালি দেওয়া তো দূরের কথা । ভীমপলশ্রী কি, কেমন তার রূপ এটা সম্যক প্রত্যক্ষ করার
পর সেই সুরের রেশ টা যেন কেউ ভাঙতে দিতে রাজি নয় !
নীরবতা ভাঙেন সেই বাদশাহী কণ্ঠের মালিকই
।
"ম্যায় উস্তাদ
আফতাব হুসেন খান হুঁ । কোই হ্যা.....য় ? .........."
******************
লেখাটা শেষ করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন
গুপ্ত সাহেব এর নামে । গল্প টার নাম দিলেন "গোধূলির আলো"।
পুনশ্চ করে লিখলেন, "বালকের বালখিল্যতায় হঠাৎ ই
"ইচ্ছেডানা"য় সওয়ার হয়ে নিজেকে
পুনর্বার আবিষ্কার করে গেলাম । ইচ্ছেডানার সকল পাঠক পাঠিকাকে অন্তরের
অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা । যাঁরা লিখছেন, তাঁদের বলি, লিখে যান মনের আনন্দে, জানবেন, অন্তরাত্মার থেকে বড় বিচারক কেউ নেই । আর পড়ুন, দেশ বিদেশের লেখা পড়ুন। পড়ুন আর লিখতে
থাকুন, লিখতে লিখতেই জীবনকে
চিনুন, সাহিত্য চিনুন, উপভোগ করুন
। শুভেচ্ছা সক্কলকে । নমস্কার ।
বিনীত ,
ইতি
গৌরসুন্দর বারুই (বোধিসত্ত্ব সেন) ।"
লেখাটা কপি করে পেস্ট করে দিলেন 'ইচ্ছেডানা'র
মেম্বার্স' পেজ এ ।
টেবিলে রাখা জলের জগ থেকে অনেকটা জল খেলেন
বোধিসত্ত্ব । খুব ঘুম পাচ্ছে । নাহ, একটা ভালো ঘুম দরকার । অনেক কাজ বাকি !
********************
।। সমাপ্ত ।।
No comments:
Post a Comment