শীতটা বোধ হয় এবার তাড়াতাড়িই
পড়বে। সবে তো মাত্র ডিসেম্বর মাসের ক’টা দিন
হয়েছে, পশ্চিমের সূর্যের তেজ যেন বিকেল হবার আগেই কেমন ম্লান হয়ে যায়। ঠিক যেন
আমাদের ফণী স্যারের মত। ছোটবেলা স্যার ক্লাসে ঢুকতেই আমাদের বুকে কেমন দুমদুম আওয়াজ
হতে লাগতো। কেউ জানেনা যে আজ কার নাম ধরে ডাকবেন স্যার। আমিতো ফণীবাবুর প্রায়
নিত্যদিনের খোরাক ছিলাম! নাম ধরে ডাকা মানেই সেই ছেলেকে স্যারের টেবিলের সামনে
গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কি করে যে এমন সব বিদঘুটে প্রশ্ন স্যারের মাথায় আসতো আমি আজো বুঝে পাইনা।
কক্ষনো অমিতেশ বা পীযুষ, মানে ক্লাসের ভালো
ছেলেদের ডাকবেন না স্যার, ডাকবেন আমাদের মতো শেষ বেঞ্চে মুখ লুকানো ছেলেদের, যাদের
কাছে অঙ্ক মানে হল পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ এক পাচন, বিজ্ঞান মানে হল চিরতার জল আর
ইতিহাস আর ভূগোল হল থানকুনি পাতার রস। আমাদের প্রতি স্যারের এত ভালবাসা যে কেন
কিছুতেই মাথায় ঢুকতো না!
‘বল, আয়তক্ষেত্র আর বর্গক্ষেত্রের
মধ্যে পার্থক্য কি?’ কি করে বলি! একদিন এসে বলবেন '৭ এর
বর্গ কত' তো আর একদিন এসে বলবেন 'বর্গক্ষেত্র কি বল'। এত যদি বুঝতাম তাহলে তো আমি অমিতেষ
এর মতো ফার্ষ্ট হতাম। আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। উত্তর না দিয়ে শুধু শুধু শাস্তি
পাবোনা। একদিন আমার নাম ডেকে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা বলতো
মাণিক, মহাকাশযান এ মহাকাশ্চারীরা কি প্রক্রিয়ায় চলাচল করে?” আমিতো জানিই যে
আমাকে আজ বধ হতেই হবে, নাহলে এই প্রশ্ন আমাকে কেন? আমি গেছি কোনোদিন মহাকাশে? এই
যে আমাদের পরের পরের পরে যে জংশন স্টেশন পলাশপুর সেখানে অবধি আমি তখনো কোনোদিন
যাইনি তো মহাকাশ! কিন্তু হ্যাঁ ছবি দেখেছি, বইতে। কিন্তু উত্তর দিতেই হবে। ছবিটাতে
একজন মহাকাশ্চারী পাখীর মত উড়ছিল, মনে আছে আমার। মহাকাশে হাঁটতে তো পারবে না, মাটি
কোথায়? চোখ বুজে মায়ের নাম স্মরণ করে বলে ফেললাম, “উড্ডয়ন
প্রক্রিয়ায় স্যার।’’ নিশ্চয়ই ঠিক বলেছি, নাহলে অবধারিত
ভাবে যে কাজটা করার কথা তা করতে বলার নির্দেশ পেয়ে যেতাম। মনে মনে অবাক হলাম, “যাক, ছবিটা মনে ছিল ভাগ্যিস, স্যার ও অবাক হয়ে গেছেন যে
মাণিক কি করে বলে দিল!” ফণী বাবুকে আমরা আড়ালে প্রেম চোপড়া বলতাম। তা সেই প্রেম চোপড়ার
আমার উত্তর শুনে মুখটা যা হয়েছিল না! ভাবতেই পারেননি যে ক্লাশের লাস্ট বয় এর
উত্তরটা জানা! আমার দারুণ মজা লাগছিল। কিন্তু সেই মজাটা স্থায়ী হলনা। অবাক করা
মুখটা কে সামলে স্যার বলে উঠলেন, “তুমি বাবা উড্ডয়ন প্রক্রিয়ায় উড়ে এসে
তোমার কর্ণখানি আমার দুই অঙ্গুলির মাঝে স্থাপন কর।" বুঝে গেলাম
কি করতে হবে। মানে আমার কান কে তার ডান হাতের আঙুলের মাঝে দিতে হবে। আর তিনি তার
পর সেই কান ধরে টেবিলের ডান দিক থেকে বা দিক অবধি ঠিক গুনে গুনে তিনবার অর্ধবৃত্তাকার
পথে একবার নিয়ে যাবেন আর একবার নিয়ে আসবেন। অর্ধবৃত্তাকার পথটা ঠিক বললাম তো? যাক
গে যাক, এখন ভুল বললে তো কেউ শাস্তি দেবে না। তা সেই ফণী স্যার এর ডাক পড়ত যখন
কোনো ছাত্র চরম গর্হিত কিছু করে ফেলত। আমাদের ওই অবনীমোহন স্কুলের মাঠের মাঝে দাঁড়
করিয়ে সেই ছাত্রকে গুনে গুনে পঞ্চাশ বেতের বাড়ী মারতেন ফণী স্যার। সেই সময় স্যার
যেন অন্যরকম এক মানুষ। ধ্যুর কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা সেদিন সেই
ফণী স্যারকে দেখলাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কেমন যেন ম্লান, হাতে লাঠি, কোথায়
সেই তেজ! ঝুঁকে কোনরকম ভাবে হাঁটছেন। প্রণাম করাতে চিনতে পারলেন না। শুনলেনই না
যেন। নাম বলাতে বললেন, “কে? কোন সাল? ৪২ না ৬২?” চিনতে পারবে কি করে, হুঁ হুঁ, আমারো তো বয়স হয়েছে। কত
যেন হল? ধ্যুর মনে নেই। যাক গে, কি যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, ওই যে সূর্যের আলো, পশ্চিম
দিকে ঢলে পড়া সূর্যের গা দিয়ে বেরোচ্ছে তার তেজ যেন ওই ফণী স্যারের মত। কেমন
নিস্তেজ, সব ভুলে যাওয়া মনের মত এলিয়ে পড়া। কিন্তু এই এলিয়ে পড়া রোদটাকে আমার ভীষণ
ভালো লাগে জানেন। মনে হয় আমার জন্যই সূর্যটা এমন ম্লান হয়ে গেছে। আমার খুব ভালো
লাগে ওই সুর্যকে গায়ে মেখে নিতে। কেন যে লাগে!
আমাদের এই পিপুলতলা স্টেশনটা
খুব সুন্দর জানেন। স্টেশন থেকে বেড়িয়েই এই পূব দিকে একটা বিরাট পিপুল গাছ, কত
বছরের পুরনো কে জানে! তার চারপাশে বাঁধানো ছিল। আগে কত বাঁশের বেড়ার দোকান ছিল। ফুলুরির দোকান, পলানের চায়ের দোকান, নিতাইয়ের সেলুন। আরো
কতকি! এখন আর কিছু নেই। আগে স্টেশন এর উত্তর দিকে একটা কেবিন ছিল।
সেটাও এখন কেমন যেন পোড়ো বাড়ির মত হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে ভাঙাচোরা লম্বা সিঁড়িটা
বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে ওই কেবিনের ঘরটাতে যাই। খুব কষ্ট লাগে আমার। মনে হয়, একদিন এই লাইন দিয়ে যত
ট্রেন যেত সব এইখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হত। লাল সিগনাল দিয়ে দিলেই ট্রেন কে থেমে যেতে
হবে, তা যতই সে এক্সপ্রেস ট্রেন হোক। সবুজ দিলেই আবার ট্রেন চালু করার ছাড়পত্র
পাবে ড্রাইভার! কেবিনম্যানের কত ক্ষমতা! কেবিনম্যান তারকদা’র সাথে আমার ভীষণ খাতির, আমাকে খুব ভালোবাসে তারকদা। কবে
ওর ভাইকে বিনে পয়সায় পড়িয়েছিলাম, সেই থেকে তারকদার কাছে আমি প্রায় দেবদূত। আমিও
সময় পেলেই তারকদার কাছে চলে আসি। নিরিবিলিতে বসে থাকার জন্য, গল্প করার জন্য।
তারকদাই তো একমাত্র লোক এই কেবিনে! আমি ছাড়া কারো এই সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার অনুমতি
নেই তারকদার কাছে। লম্বা দেওয়ালের পাশে লাইন কে এদিক ওদিক করার লোহার বড় বড় তিন
চারটে রড এখনো আছে। সেগুলো কাজ করেনা যদিও, আমি জানি। কিন্তু এই কেবিনটাই শুধু আমার প্রিয় জায়গা নয়।
আমার আরো একটা প্রিয় জায়গা হল এই পিপুলতলা স্টেশনের একমাত্র যে প্লাটফর্ম আছে তার দক্ষিণ
প্রান্তের সিমেন্টের বেঞ্চটা। ওই বেঞ্চটায় বসলে স্টেশনের পশ্চিমদিকের যে মাঠটা
আছে, যেখানে বর্ষার সময় জল থৈ থৈ করে, আর এই দূর্গা পূজা আসলেই সাদা সাদা ঘন
কাশফুলে ঢেকে যায়, সেখান দিয়ে ওই মাঠের ওপারে সূর্যটাকে ডুবে যেতে দেখা যায়। কি যে অপরূপ সে দৃশ্য, আমার মন কেমন করে ওঠে। মনে হয় আমার জন্যই সূর্যটা উঠেছিল, আর আমার জন্যই
ডুবে গেল। আমার সারা শরীরে তার স্নিগ্ধ আলোর মায়া মাখিয়ে দিয়ে।
স্টেশনটা উঠে যাবার পর এদিকে
লোকজন ও সব কেমন যেন ভোজবাজির মত উবে গেল। স্টেশনের পূব দিকের আগের সেই জমজমাট
ভাবটাই আর নেই। সব আস্তে আস্তে চলে গেছে নতুন ওই পায়রাদীঘি স্টেশনের কাছে। সেটাও
এখান থেকে আধঘন্টা হাঁটা পথ তো হবেই। সেখান থেকে এক নতুন লাইন হয়েছে, পলাশপুর জংশন
নাকি অনেক কাছে হয়ে গেছে তাই। আমাদের পিপুলতলার দিকে এখন আর কেউ আসেনা। সারাদিনে,
চারপাঁচটা ট্রেন এই পিপুলতলার উপর দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে যায়। আমি প্লাটফর্মের
বেঞ্চে বসে ভাবি, বিকেলের ট্রেন থেকে কত মানুষ নামতো এখানে, এখন কেউ আর আসেনা। পশ্চিম
দিকে কোনো বসতি নেই। স্টেশন থেকে এই দশ মিনিট হাঁটলেই দরবেশের খাল। কি জানি কেন
দরবেশের খাল নাম হল! আমি জানিনা। তবে ওদিকটায় কেউ যায়না। তখনো ছিলনা কোনো বসতি,
এখন তো আরো নেই। ওই পাড়ে শুধু বৈশাখ মাসে একটা মেলা হত। খুব ঘটা করে একটা কালী পূজা হত। এই স্টেশনের পাশে যাদের দোকান টোকান ছিল তারাই সব উদ্যোক্তা। সবাই বলত দরবেশের মেলা।
খুব মজা হত। কত দূর থেকে সব লোকজন আসতো সেই মেলায়। পুরো এক মাস চলত সেই মেলা। মেলা
শেষ হলে ব্যাপারীরা জিনিসপত্র গাড়িতে করে নিয়ে চলে যেত। কোথায় যে যেত! আষাঢ় মাসে
যেই আকাশ ফুঁড়ে বর্ষা নামতো সেই মেলার জায়গা ধীরে ধীরে আগাছায় ভরে যেত। আর
শ্রাবণের বৃষ্টি যখন চারদিক ভাসিয়ে দিত তখন ওই দরবেশের মেলার মাঠ আর দরবেশের খাল
আলাদা করে কিছু বোঝা যেত না, স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে খালের ও দিকটায় তাকালে শুধু
জল আর জল! আমাদের অবনীমোহন স্কুলটা ছিল স্টেশন থেকে দশ মিনিটের রাস্তা, উত্তর
দিকে, মানে ওই পায়রাদীঘির দিকে আর কি। বাংলার বিভূতি বাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
মাধ্যমিকে সবাই তো দারুণ সব রেজাল্ট করল। অমিতেষ তো জেলাতে দ্বিতীয় হল। আমি কিন্তু
ফেল করিনি। খেটে খুটে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে ছিলাম। কিন্তু বিভূতি বাবুই স্কুল
কতৃপক্ষ আয়োজিত কৃতী ছাত্রদের সম্বর্ধনার
অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকে পাঠালেন! সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক সময় আমার নাম ডাকা হল।
বিভূতিবাবু নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ফাউন্টেন পেন এর প্যাকেট বের করে
বললেন, “ভালো ছাত্ররা তো ভালো করবেই, কিন্তু
যারা সব বিষয়ে চৌকস না হয়েও বলার মত উন্নতি করে সেটাও একটা কৃতিত্ব। আমি গর্বের
সাথে বলছি, আমাদের স্কুলের ছাত্র মাণিক এইরকম এক কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সারা জেলার
মধ্যে বাংলাতে সবচেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছে আমাদের মাণিক।’’ আমার মাথায়
কিছু ঢুকছিলনা। এটা সত্যি? জানতাম না তো! আমার যেন কেমন করতে লাগলো। কেমন যেন লজ্জা
পেতে লাগ্লাম। কিন্তু সেদিন কানের মধ্যে খালি অনেক হাত তালির আওয়াজ ভেসে এসেছিল। বিভুতিস্যারের পেনটা আমি কোনোদিন হাতছাড়া করিনি। ওই পেন দিয়েই তো প্রথম কবিতা লিখে
দিয়েছিলাম ক্ষমা কে।
সেই আমার প্রথম পিপুলতলার বাইরে
যাওয়া। বাড়িতে শুধু মা। সামান্য জমি যা ভাগে ছিল তা দিয়ে কাকারা চাষ করাতেন, তার
থেকে অর্ধেক বছরের ধান আর সব্জিটা পাওয়া যেত। বাদবাকি সময় কারো বাড়িতে ধান ভেনে,
কখনও বা ঘরকন্যার কাজে সাহায্য করে যা আয় হোত তা দিয়ে মা ছেলের চলে যেত। বাবাকে তো
আমি দেখিই নি, বাবা নাকি কলকাতাতে কোন দোকানে ব্লাউজ বানাতেন। কলকাতাতেই থাকতেন,
হয়ত মাসে একবার দুইবার আসতেন। আমি যখন মায়ের পেটে তখন নাকি একদিন খবর আসে যে বাবা
আর নেই। কিন্তু কিভাবে বাবা মারা গেছেন সে বিষয়ে মা কে কোনও দিন কিছু বলতে শুনিনি।
আমি জিজ্ঞাসা করলেও মা ঠিক মত উত্তর দিতো না। আমিও আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করা ছেড়ে
দিলাম। মা শুধু আমাকে বলতো, ‘তোকে পড়াশুনা শিখে মাষ্টার হতে হবে।
এর বেশী আমি কিছু চাইনা’। কিন্তু আমি কি করি! আমার যে অংক,
বিজ্ঞান কিছু মাথায় ঢোকে না। মাধ্যমিকটা কোন ভাবে উতরে যেতেই বুঝলাম যে মায়ের সাধ
পূরণ করা অসম্ভব না। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম? দেখলেন তো আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলি।
বলছিলাম কি আর কোন কথায় চলে গেলাম। আসলে কি জানেন, আমার মাথায় চিন্তাগুলো একটার পর
একটা সূত্র ধরে আসতেই থাকে। আমাকে ক্ষমা করবেন। ও হ্যাঁ, ক্ষমা।
পলাশপুর মহাবিদ্যালয় এর নবীন
বরণ। আমিতো গ্রাম থেকে এসেছি। এই নবীন বরণ টা কি? বুঝি না বুঝি যাই তো, তমাল আর
আমি ঠিক সময়ে ঠিক দিনে হাজির হলাম আমার কলেজ এ। তখন ওটাই ছিল কলেজ, তা যতই এগারো
ক্লাসে পড়ি। ডিগ্রি ক্লাসও তো হয়, তাই অবশ্যই কলেজ। তমাল আমাদের পাশের গ্রামে
থাকতো। এই নতুন কলেজে ওইই একমাত্র বন্ধু যে আমার সাথে এই অবনীমোহন স্কুল এর ক্লাস
ফাইভ থেকে একসাথে পড়েছে। সেই প্রথম আমাদের বাইরে বেরনো। নবীন বরণ এর অনুষ্ঠান
আমাদের ভীষণ ভালো লাগলো। বড় দাদা দিদিদের হাত থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপের কুঁড়ি
পেয়ে নিজেকে এত দামী মনে হতে লাগলো যে আমাদের মনের আনন্দ আর ধরেনা! মেয়েদের সাথে
একসাথে আমরা কোনদিন বসিনি, ক্লাস করিনি, একসাথে গল্প করাতো অনেক দূরের কথা। আমরা
জানতামও না যে মেয়েরা ছেলেদের বন্ধু হতে পারে। কিন্তু ওই প্রথম দিনই আমার চোখ আটকে
গেল অনেক মাথার মাঝখান দিয়ে দেখা একটা চোখের দিকে। বিকেলের ট্রেন এ ফেরার সময় তমাল
বলল, “গার্গীকে কেমন দেখলি?” আমি তো চিনতেই পারছিনা, কে গার্গী! আমার তো মন জুড়ে
একটা মাত্র মুখ। শ্যামলা একটা মুখ আর তার শান্ত দীঘির মতন গভীর এক জোড়া চোখ, আর
সেই চোখের মাঝে কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ভালোবাসা কি প্রথম দর্শনে হয়? জানিনা, আমার
কিন্তু ভীষণ ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল এই মুখ আর সবার থেকে আলাদা, এই মুখে
চটকদারীর আলো ঠিকরায় না, কিন্তু অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় মন। তমাল আমার মনের
কথা জেনে বলেছিল, ‘তুই জানিস ও কে? ও হল পলাশপুরের
মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান এর মেয়ে।’ যা বাবা, আমি কি করে জানবো, আমার ভালো লেগেছে ওই
কালো হরিণ চোখের মেয়েটিকে, আমার কি কার মেয়ে জেনে কাউকে ভালোলাগবে নাকি!
দু বছর আমরা বিশেষ কথা টথা
বলিনি। গ্রামের ছেলেতো, এমনিতেই সবসময় কুঁকড়ে থাকতাম। ক্লাস করেই বাড়ি ফিরতে হবে।
আমিতো তখন ছোট ক্লাসের পাঁচ ছয় জনকে পড়াই। নাহলে নিজের যাতায়াতের, পড়াশোনার খরচা
কে দেবে বলুন? হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পরে আমাদের ক্লাস থেকে আমি আর ক্ষমাই শুধু বাংলা অনার্স নিয়ে ওই কলেজে ভর্তি হলাম।
কেউ ফিলসফি কেউ বা রাস্ট্রবিজ্ঞান এ অনার্স এ সুযোগ পেল, আর বাকিদের কেউ পাস
কোর্সে। বাকিদের বেশীরভাগ হারিয়ে গেল। একদিন এস কে বি স্যারের ক্লাস করে তাড়াতাড়ি
বেড়িয়ে পলাশপুর স্টেশনের দিকে হাঁটছি, পিছন থেকে ক্ষমা ডাকলো, ‘এই মাণিক শোন’। আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। কাছে দৌড়ে
এসে ক্ষমা বলল, ‘আমি বাঘ না ভাল্লুক? আমাকে দেখে দৌড়ে
পালাও কেন?’ জানি ভাববেন যে গল্প, কিন্তু
বিশ্বাস করুন সেদিন না পলাশপুরের ওই গ্রামো রেডিও বলে যে ক্যাসেট এর দোকানটা ছিল
সে দোকান থেকে মান্না দে’র ওই গানটা ভেসে আসছিল, “জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, পাছে ভালো বেসে
ফেলো তাই দূরে দূরে রই”!
ক্ষমাই আমাকে কাছে টেনে নিল।
নাহলে গরীব, বাপ মড়া চাষার বাড়ির চালচুলোহীন আমার পক্ষে ক্ষমার মতন কারো কাছে
যাবার সাহসও হোত না কোনদিন। ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা। কি যে দেখেছিল ক্ষমা আমার
মধ্যে কে জানে। কিন্তু ভীষণ ভালবাসত জানেন। কি করে যে এত ভালোবাসা দিয়ে ভগবান
নারীদের তৈরী করেন কে জানে! ছোট থেকে মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি, তারপরে এল
ক্ষমা। জানেন প্রতিদিন, প্রতিদিন আমার জন্য কিছুনা কিছু খাবার নিয়ে আসতো ক্ষমা, ও
জানতো যে সকালে আমি কিছু খেয়ে যেতে পারিনা কলেজে। আমি ভীষণ অবাক হয়ে ভাবতাম ওই ছোটখাট চেহারার
মেয়েটার বুকের ভিতর এত সাহস কি করে! কি’করে আমার মত কপর্দকহীন এক ছেলেকে এতটা ভালোবাসার সাহস
পায় ও! ‘কেন এত ভালোবাসো’ জিজ্ঞাসা করলে
বলতো, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, এত কেন টেনো আমি
জানিনা।’ তারপর বলল, ‘মাণিক আমার, ক্ষমা মাণিকের। আমি মরে গেলেও কেউ আমার থেকে
আমার মাণিক কে আলাদা করতে পারবেনা।’ ওর ওই গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি
কি বলব, শুধু ভয় পেতাম। একদিন বলেই ফেললেম, “তোমার বাবা যদি
না মানেন?’ কি একটা বের করছিল ক্ষমা ব্যাগ
থেকে, চোখ তুলে আমাকে বলল, ‘মানবে না তো, কিছুতেই মানবে না, তাই
পাশ করার পরেই আমি চলে আসবো তোমার কাছে, তোমার মা আমাকে আশ্রয় দেবেন না?’ তারপর আবার একটু থেমে বলল, ‘আমি আমার মা
কে চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি মাণিক, আমি তখন ক্লাস সেভেন। ওই শয়তানটা আমার মা
কে মেরে ফেলেছে। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি, কবে আমি ওই নরক থেকে বেড়িয়ে আসবো। এর
বাইরে তুমি আমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞাসা কোরোনা, আমিও বলব না। শুধু আমাকে তোমার বাড়িতে
আশ্রয় দিও’।
আজকে সেই দিন জানেন। আমি একটা
স্কুলে চাকরী পেয়েছি, আমাদের গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার দূরে আনন্দপুর গ্রামে।
প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারমশাই এর চাকরী। ক্ষমা ওর বাবা কে জানিয়েছে যে ও বাড়ি ছেড়ে
চলে যাবে। আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথাও জানিয়েছে। যথারীতি ওর বাবা এই সম্পর্ক কে
গুরুত্বই দেন নি। বলেছেন নাকি যে এইসব খামখেয়ালীপনা উনি বরদাস্ত করবেন না, ক্ষমাকে
নিয়ে তার অন্য পরিকল্পনা আছে। তমালকে দিয়ে ক্ষমা খবর পাঠিয়েছে যে আজই ও চলে আসবে
বাড়ি ছেড়ে। আমি কি পারবো বলুন ওকে সুখী করতে? মা তো ভীষণ খুশী, শুধু বললেন যে ওর
বাবা মেনে নিলে ভালো হোত আরো, এক মেয়ে তো, পরে নিশ্চয়ই মেনে নেবে। আমি আসি এখন?
পাঁচটা চল্লিশ এর ট্রেন এ ক্ষমা আসবে, আমাকে প্লাটফর্মের ওই দক্ষিণ দিকে গিয়ে অপেক্ষা
করতে হবে। পাঁচটা চল্লিশ বাজতে চলল প্রায়। ওই ডাউন ট্রেন এই ক্ষমা আসবে। ক্ষমা
সেরকমই বলে দিয়েছে। আসি কেমন?
************
ক্ষমা কোনোদিন তার মাণিকের কাছে
আসেনি। আসতে পারেনি বলাটাই ভালো। প্রভাবশালী বাবা মেয়ের এরকম বেয়াদপী মেনে নিতে
পারেন নি। বাড়ি ছেড়ে পালাবার আগেই ধরা পড়ে যায় ক্ষমা। দু’জন ভীষণ বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে সেদিনই মেয়ে
কে প্রথমে মুম্বাই, তারপরে দেশের বাইরে চালান করে দেন ক্ষমার বাবা। বিদেশে থাকা
কোন আত্মীয়ের কাছে। ক্ষমা এখন নিউ জার্সিতে থাকে। বিয়েও করেছে। ছেলে মেয়েও আছে
একটি করে। মাণিক কে তার মনে আছে কিনা?
জানা নেই। কতকিছুই তো কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। কিছু হয়তো পড়ে থাকে মনের গভীরে,
অনাদরে, সবার অলক্ষে লুকিয়ে রাখা এক বন্ধ কুঠুরিতে। হয়ত কোন এক উদাস বিকেলে হাইওয়ে
দিয়ে ড্রাইভ করে যাবার সময় পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে ওর মনে পড়ে যায় সরল সাদাসিধে
নিস্পাপ এক যুবকের মুখ, যে হয়ত তার বুকের সবটুকু কথা উজাড় করে তাকে উপহার দিয়েছিল
একটা কবিতা।
************
অনেক বছর আগে মাণিক নামে এই
পিপুলতলার এক যুবকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল স্টেশনের ওই দক্ষিণপ্রান্তে লাইনের ধারে। লোক মুখে কথিত আছে কোনো এক
ডিসেম্বরের সন্ধ্যার অন্ধকারে কে বা কারা ছেলেটিকে কুপিয়ে মেরে ট্রেনের লাইনে ফেলে
দিয়েছিল। কেউ বা বলে ট্রেনের তলায় কাটা পড়েছিল এক যুবক। সত্যিটা যে কি তা কেউ
জানেনা।
কিন্তু আজও যখন আশ্বিন শেষের
বিকেলে প্রকৃতি মন খারাপ করা শীতশীতে বাতাসের চাদর মুড়ি দিয়ে ফেলে, দরবেশের খাল এর
দিকে পশ্চিম প্রান্তে সূর্যটা অস্ত গিয়ে চারদিক মন উদাস করা ঘোলাটে ম্লান আলোয় ঢাকা
পড়ে যায়, ওই দিগন্ত প্রসারিত শূন্যতা থেকে একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝলক বয়ে আসে
পরিত্যক্ত প্লাটফর্মের দিকে, পিপুলতলা স্টেশনের দক্ষিণপ্রান্তের ওই বেঞ্চটাতে এক
যুবককে বসে থাকতে দেখে কেউ কেউ। সে শুধুই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে দক্ষিণ দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া ওই রেল
লাইনের দিকে। পাঁচটা চল্লিশ এর ডাউন ট্রেনের প্রতীক্ষায়।
সমাপ্ত।।