Search This Blog

Thursday 28 September 2017

প্রতীক্ষা



শীতটা বোধ হয় এবার তাড়াতাড়িই পড়বে। সবে তো মাত্র ডিসেম্বর মাসের কটা দিন হয়েছে, পশ্চিমের সূর্যের তেজ যেন বিকেল হবার আগেই কেমন ম্লান হয়ে যায়। ঠিক যেন আমাদের ফণী স্যারের মত। ছোটবেলা স্যার ক্লাসে ঢুকতেই আমাদের বুকে কেমন দুমদুম আওয়াজ হতে লাগতো। কেউ জানেনা যে আজ কার নাম ধরে ডাকবেন স্যার। আমিতো ফণীবাবুর প্রায় নিত্যদিনের খোরাক ছিলাম! নাম ধরে ডাকা মানেই সেই ছেলেকে স্যারের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবেকি করে যে এমন সব বিদঘুটে প্রশ্ন স্যারের মাথায় আসতো আমি আজো বুঝে পাইনা। কক্ষনো অমিতেশ বা পীযুষ, মানে ক্লাসের ভালো ছেলেদের ডাকবেন না স্যার, ডাকবেন আমাদের মতো শেষ বেঞ্চে মুখ লুকানো ছেলেদের, যাদের কাছে অঙ্ক মানে হল পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ এক পাচন, বিজ্ঞান মানে হল চিরতার জল আর ইতিহাস আর ভূগোল হল থানকুনি পাতার রসআমাদের প্রতি স্যারের এত ভালবাসা যে কেন কিছুতেই মাথায় ঢুকতো না! 
বল, আয়তক্ষেত্র আর বর্গক্ষেত্রের মধ্যে পার্থক্য কি? কি করে বলি! একদিন এসে বলবেন '৭ এর বর্গ কত' তো আর একদিন এসে বলবেন 'বর্গক্ষেত্র কি বল'। এত যদি বুঝতাম তাহলে তো আমি অমিতেষ এর মতো ফার্ষ্ট হতাম। আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই। উত্তর না দিয়ে শুধু শুধু শাস্তি পাবোনা। একদিন আমার নাম ডেকে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা বলতো মাণিক, মহাকাশযান এ মহাকাশ্চারীরা কি প্রক্রিয়ায় চলাচল করে? আমিতো জানিই যে আমাকে আজ বধ হতেই হবে, নাহলে এই প্রশ্ন আমাকে কেন? আমি গেছি কোনোদিন মহাকাশে? এই যে আমাদের পরের পরের পরে যে জংশন স্টেশন পলাশপুর সেখানে অবধি আমি তখনো কোনোদিন যাইনি তো মহাকাশ! কিন্তু হ্যাঁ ছবি দেখেছি, বইতে। কিন্তু উত্তর দিতেই হবে। ছবিটাতে একজন মহাকাশ্চারী পাখীর মত উড়ছিল, মনে আছে আমার। মহাকাশে হাঁটতে তো পারবে না, মাটি কোথায়? চোখ বুজে মায়ের নাম স্মরণ করে বলে ফেললাম, উড্ডয়ন প্রক্রিয়ায় স্যার।’’ নিশ্চয়ই ঠিক বলেছি, নাহলে অবধারিত ভাবে যে কাজটা করার কথা তা করতে বলার নির্দেশ পেয়ে যেতাম। মনে মনে অবাক হলাম, যাক, ছবিটা মনে ছিল ভাগ্যিস, স্যার ও অবাক হয়ে গেছেন যে মাণিক কি করে বলে দিল! ফণী বাবুকে আমরা  আড়ালে প্রেম চোপড়া বলতাম। তা সেই প্রেম চোপড়ার আমার উত্তর শুনে মুখটা যা হয়েছিল না! ভাবতেই পারেননি যে ক্লাশের লাস্ট বয় এর উত্তরটা জানা! আমার দারুণ মজা লাগছিল। কিন্তু সেই মজাটা স্থায়ী হলনা। অবাক করা মুখটা কে সামলে স্যার বলে উঠলেন, তুমি বাবা উড্ডয়ন প্রক্রিয়ায় উড়ে এসে তোমার কর্ণখানি আমার দুই অঙ্গুলির মাঝে স্থাপন কর।" বুঝে গেলাম কি করতে হবে। মানে আমার কান কে তার ডান হাতের আঙুলের মাঝে দিতে হবে। আর তিনি তার পর সেই কান ধরে টেবিলের ডান দিক থেকে বা দিক অবধি ঠিক গুনে গুনে তিনবার অর্ধবৃত্তাকার পথে একবার নিয়ে যাবেন আর একবার নিয়ে আসবেন। অর্ধবৃত্তাকার পথটা ঠিক বললাম তো? যাক গে যাক, এখন ভুল বললে তো কেউ শাস্তি দেবে না। তা সেই ফণী স্যার এর ডাক পড়ত যখন কোনো ছাত্র চরম গর্হিত কিছু করে ফেলত। আমাদের ওই অবনীমোহন স্কুলের মাঠের মাঝে দাঁড় করিয়ে সেই ছাত্রকে গুনে গুনে পঞ্চাশ বেতের বাড়ী মারতেন ফণী স্যার। সেই সময় স্যার যেন অন্যরকম এক মানুষ। ধ্যুর কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা সেদিন সেই ফণী স্যারকে দেখলাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কেমন যেন ম্লান, হাতে লাঠি, কোথায় সেই তেজ! ঝুঁকে কোনরকম ভাবে হাঁটছেন। প্রণাম করাতে চিনতে পারলেন না। শুনলেনই না যেন। নাম বলাতে বললেন, কে? কোন সাল? ৪২ না ৬২? চিনতে পারবে কি করে, হুঁ হুঁ, আমারো তো বয়স হয়েছে। কত যেন হল? ধ্যুর মনে নেই। যাক গে, কি যেন বলছিলাম? হ্যাঁ, ওই যে সূর্যের আলো, পশ্চিম দিকে ঢলে পড়া সূর্যের গা দিয়ে বেরোচ্ছে তার তেজ যেন ওই ফণী স্যারের মত। কেমন নিস্তেজ, সব ভুলে যাওয়া মনের মত এলিয়ে পড়া। কিন্তু এই এলিয়ে পড়া রোদটাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে জানেন। মনে হয় আমার জন্যই সূর্যটা এমন ম্লান হয়ে গেছে। আমার খুব ভালো লাগে ওই সুর্যকে গায়ে মেখে নিতে। কেন যে লাগে!

আমাদের এই পিপুলতলা স্টেশনটা খুব সুন্দর জানেন। স্টেশন থেকে বেড়িয়েই এই পূব দিকে একটা বিরাট পিপুল গাছ, কত বছরের পুরনো কে জানে! তার চারপাশে বাঁধানো ছিলআগে কত বাঁশের বেড়ার দোকান ছিল। ফুলুরির দোকান, পলানের চায়ের দোকান, নিতাইয়ের সেলুন। আরো কতকি!  এখন আর কিছু নেই।  আগে স্টেশন এর উত্তর দিকে একটা কেবিন ছিল। সেটাও এখন কেমন যেন পোড়ো বাড়ির মত হয়ে গেছে। আমি মাঝে মাঝে ভাঙাচোরা লম্বা সিঁড়িটা বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে ওই কেবিনের ঘরটাতে যাইখুব কষ্ট লাগে আমার। মনে হয়, একদিন এই লাইন দিয়ে যত ট্রেন যেত সব এইখান থেকে নিয়ন্ত্রণ হত। লাল সিগনাল দিয়ে দিলেই ট্রেন কে থেমে যেতে হবে, তা যতই সে এক্সপ্রেস ট্রেন হোক। সবুজ দিলেই আবার ট্রেন চালু করার ছাড়পত্র পাবে ড্রাইভার! কেবিনম্যানের কত ক্ষমতা! কেবিনম্যান তারকদার সাথে আমার ভীষণ খাতির, আমাকে খুব ভালোবাসে তারকদা। কবে ওর ভাইকে বিনে পয়সায় পড়িয়েছিলাম, সেই থেকে তারকদার কাছে আমি প্রায় দেবদূত। আমিও সময় পেলেই তারকদার কাছে চলে আসি। নিরিবিলিতে বসে থাকার জন্য, গল্প করার জন্য। তারকদাই তো একমাত্র লোক এই কেবিনে! আমি ছাড়া কারো এই সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার অনুমতি নেই তারকদার কাছে। লম্বা দেওয়ালের পাশে লাইন কে এদিক ওদিক করার লোহার বড় বড় তিন চারটে রড এখনো আছে। সেগুলো কাজ করেনা যদিও, আমি জানি।  কিন্তু এই কেবিনটাই শুধু আমার প্রিয় জায়গা নয়। আমার আরো একটা প্রিয় জায়গা হল এই পিপুলতলা স্টেশনের একমাত্র যে প্লাটফর্ম আছে তার দক্ষিণ প্রান্তের সিমেন্টের বেঞ্চটা। ওই বেঞ্চটায় বসলে স্টেশনের পশ্চিমদিকের যে মাঠটা আছে, যেখানে বর্ষার সময় জল থৈ থৈ করে, আর এই দূর্গা পূজা আসলেই সাদা সাদা ঘন কাশফুলে ঢেকে যায়, সেখান দিয়ে ওই মাঠের ওপারে সূর্যটাকে ডুবে যেতে দেখা যায়কি যে অপরূপ সে দৃশ্য, আমার মন কেমন করে ওঠে। মনে হয় আমার জন্যই সূর্যটা উঠেছিল, আর আমার জন্যই ডুবে গেল। আমার সারা শরীরে তার স্নিগ্ধ আলোর মায়া মাখিয়ে দিয়ে।  
স্টেশনটা উঠে যাবার পর এদিকে লোকজন ও সব কেমন যেন ভোজবাজির মত উবে গেল। স্টেশনের পূব দিকের আগের সেই জমজমাট ভাবটাই আর নেই। সব আস্তে আস্তে চলে গেছে নতুন ওই পায়রাদীঘি স্টেশনের কাছে। সেটাও এখান থেকে আধঘন্টা হাঁটা পথ তো হবেই। সেখান থেকে এক নতুন লাইন হয়েছে, পলাশপুর জংশন নাকি অনেক কাছে হয়ে গেছে তাই। আমাদের পিপুলতলার দিকে এখন আর কেউ আসেনা। সারাদিনে, চারপাঁচটা ট্রেন এই পিপুলতলার উপর দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলে যায়। আমি প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে ভাবি, বিকেলের ট্রেন থেকে কত মানুষ নামতো এখানে, এখন কেউ আর আসেনা। পশ্চিম দিকে কোনো বসতি নেই। স্টেশন থেকে এই দশ মিনিট হাঁটলেই দরবেশের খাল। কি জানি কেন দরবেশের খাল নাম হল! আমি জানিনা। তবে ওদিকটায় কেউ যায়না। তখনো ছিলনা কোনো বসতি, এখন তো আরো নেই। ওই পাড়ে শুধু বৈশাখ মাসে একটা মেলা হত।  খুব ঘটা করে একটা কালী পূজা হতএই স্টেশনের পাশে যাদের দোকান টোকান ছিল তারাই সব উদ্যোক্তা। সবাই বলত দরবেশের মেলা। খুব মজা হত। কত দূর থেকে সব লোকজন আসতো সেই মেলায়। পুরো এক মাস চলত সেই মেলা। মেলা শেষ হলে ব্যাপারীরা জিনিসপত্র গাড়িতে করে নিয়ে চলে যেত। কোথায় যে যেত! আষাঢ় মাসে যেই আকাশ ফুঁড়ে বর্ষা নামতো সেই মেলার জায়গা ধীরে ধীরে আগাছায় ভরে যেত। আর শ্রাবণের বৃষ্টি যখন চারদিক ভাসিয়ে দিত তখন ওই দরবেশের মেলার মাঠ আর দরবেশের খাল আলাদা করে কিছু বোঝা যেত না, স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে খালের ও দিকটায় তাকালে শুধু জল আর জল! আমাদের অবনীমোহন স্কুলটা ছিল স্টেশন থেকে দশ মিনিটের রাস্তা, উত্তর দিকে, মানে ওই পায়রাদীঘির দিকে আর কি। বাংলার বিভূতি বাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। মাধ্যমিকে সবাই তো দারুণ সব রেজাল্ট করল। অমিতেষ তো জেলাতে দ্বিতীয় হল। আমি কিন্তু ফেল করিনি। খেটে খুটে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে ছিলাম। কিন্তু বিভূতি বাবুই স্কুল কতৃপক্ষ আয়োজিত  কৃতী ছাত্রদের সম্বর্ধনার অনুষ্ঠানে আমাকে ডেকে পাঠালেন! সবাইকে অবাক করে দিয়ে এক সময় আমার নাম ডাকা হল। বিভূতিবাবু নিজের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ফাউন্টেন পেন এর প্যাকেট বের করে বললেন, ভালো ছাত্ররা তো ভালো করবেই, কিন্তু যারা সব বিষয়ে চৌকস না হয়েও বলার মত উন্নতি করে সেটাও একটা কৃতিত্ব। আমি গর্বের সাথে বলছি, আমাদের স্কুলের ছাত্র মাণিক এইরকম এক কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সারা জেলার মধ্যে বাংলাতে সবচেয়ে বেশী নম্বর পেয়েছে আমাদের মাণিক।’’ আমার মাথায় কিছু ঢুকছিলনা। এটা সত্যি? জানতাম না তো! আমার যেন কেমন করতে লাগলো। কেমন যেন লজ্জা পেতে লাগ্লাম। কিন্তু সেদিন কানের মধ্যে খালি অনেক হাত তালির আওয়াজ ভেসে এসেছিলবিভুতিস্যারের পেনটা আমি কোনোদিন হাতছাড়া করিনি। ওই পেন দিয়েই তো প্রথম কবিতা লিখে দিয়েছিলাম ক্ষমা কে।
সেই আমার প্রথম পিপুলতলার বাইরে যাওয়া। বাড়িতে শুধু মা। সামান্য জমি যা ভাগে ছিল তা দিয়ে কাকারা চাষ করাতেন, তার থেকে অর্ধেক বছরের ধান আর সব্জিটা পাওয়া যেত। বাদবাকি সময় কারো বাড়িতে ধান ভেনে, কখনও বা ঘরকন্যার কাজে সাহায্য করে যা আয় হোত তা দিয়ে মা ছেলের চলে যেত। বাবাকে তো আমি দেখিই নি, বাবা নাকি কলকাতাতে কোন দোকানে ব্লাউজ বানাতেন। কলকাতাতেই থাকতেন, হয়ত মাসে একবার দুইবার আসতেন। আমি যখন মায়ের পেটে তখন নাকি একদিন খবর আসে যে বাবা আর নেই। কিন্তু কিভাবে বাবা মারা গেছেন সে বিষয়ে মা কে কোনও দিন কিছু বলতে শুনিনি। আমি জিজ্ঞাসা করলেও মা ঠিক মত উত্তর দিতো না। আমিও আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করা ছেড়ে দিলাম। মা শুধু আমাকে বলতো, তোকে পড়াশুনা শিখে মাষ্টার হতে হবে। এর বেশী আমি কিছু চাইনাকিন্তু আমি কি করি! আমার যে অংক, বিজ্ঞান কিছু মাথায় ঢোকে না। মাধ্যমিকটা কোন ভাবে উতরে যেতেই বুঝলাম যে মায়ের সাধ পূরণ করা অসম্ভব না। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম? দেখলেন তো আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলি। বলছিলাম কি আর কোন কথায় চলে গেলাম। আসলে কি জানেন, আমার মাথায় চিন্তাগুলো একটার পর একটা সূত্র ধরে আসতেই থাকে। আমাকে ক্ষমা করবেন। ও হ্যাঁ, ক্ষমা।
পলাশপুর মহাবিদ্যালয় এর নবীন বরণ। আমিতো গ্রাম থেকে এসেছি। এই নবীন বরণ টা কি? বুঝি না বুঝি যাই তো, তমাল আর আমি ঠিক সময়ে ঠিক দিনে হাজির হলাম আমার কলেজ এ। তখন ওটাই ছিল কলেজ, তা যতই এগারো ক্লাসে পড়ি। ডিগ্রি ক্লাসও তো হয়, তাই অবশ্যই কলেজ। তমাল আমাদের পাশের গ্রামে থাকতো। এই নতুন কলেজে ওইই একমাত্র বন্ধু যে আমার সাথে এই অবনীমোহন স্কুল এর ক্লাস ফাইভ থেকে একসাথে পড়েছে। সেই প্রথম আমাদের বাইরে বেরনো। নবীন বরণ এর অনুষ্ঠান আমাদের ভীষণ ভালো লাগলো। বড় দাদা দিদিদের হাত থেকে একটা টকটকে লাল গোলাপের কুঁড়ি পেয়ে নিজেকে এত দামী মনে হতে লাগলো যে আমাদের মনের আনন্দ আর ধরেনা! মেয়েদের সাথে একসাথে আমরা কোনদিন বসিনি, ক্লাস করিনি, একসাথে গল্প করাতো অনেক দূরের কথা। আমরা জানতামও না যে মেয়েরা ছেলেদের বন্ধু হতে পারে। কিন্তু ওই প্রথম দিনই আমার চোখ আটকে গেল অনেক মাথার মাঝখান দিয়ে দেখা একটা চোখের দিকে। বিকেলের ট্রেন এ ফেরার সময় তমাল বলল, গার্গীকে কেমন দেখলি? আমি তো চিনতেই পারছিনা, কে গার্গী! আমার তো মন জুড়ে একটা মাত্র মুখ। শ্যামলা একটা মুখ আর তার শান্ত দীঘির মতন গভীর এক জোড়া চোখ, আর সেই চোখের মাঝে কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ভালোবাসা কি প্রথম দর্শনে হয়? জানিনা, আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লেগেছিল, মনে হয়েছিল এই মুখ আর সবার থেকে আলাদা, এই মুখে চটকদারীর আলো ঠিকরায় না, কিন্তু অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় মন। তমাল আমার মনের কথা জেনে বলেছিল, তুই জানিস ও কে? ও হল পলাশপুরের মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান এর মেয়ে।  যা বাবা, আমি কি করে জানবো, আমার ভালো লেগেছে ওই কালো হরিণ চোখের মেয়েটিকে, আমার কি কার মেয়ে জেনে কাউকে ভালোলাগবে নাকি!
দু বছর আমরা বিশেষ কথা টথা বলিনি। গ্রামের ছেলেতো, এমনিতেই সবসময় কুঁকড়ে থাকতাম। ক্লাস করেই বাড়ি ফিরতে হবে। আমিতো তখন ছোট ক্লাসের পাঁচ ছয় জনকে পড়াই। নাহলে নিজের যাতায়াতের, পড়াশোনার খরচা কে দেবে বলুন? হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পরে আমাদের ক্লাস থেকে আমি আর ক্ষমাই  শুধু বাংলা অনার্স নিয়ে ওই কলেজে ভর্তি হলাম। কেউ ফিলসফি কেউ বা রাস্ট্রবিজ্ঞান এ অনার্স এ সুযোগ পেল, আর বাকিদের কেউ পাস কোর্সে। বাকিদের বেশীরভাগ হারিয়ে গেল। একদিন এস কে বি স্যারের ক্লাস করে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পলাশপুর স্টেশনের দিকে হাঁটছি, পিছন থেকে ক্ষমা ডাকলো, এই মাণিক শোনআমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। কাছে দৌড়ে এসে ক্ষমা বলল, আমি বাঘ না ভাল্লুক? আমাকে দেখে দৌড়ে পালাও কেন? জানি ভাববেন যে গল্প, কিন্তু বিশ্বাস করুন সেদিন না পলাশপুরের ওই গ্রামো রেডিও বলে যে ক্যাসেট এর দোকানটা ছিল সে দোকান থেকে মান্না দের ওই গানটা ভেসে আসছিল, জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, পাছে ভালো বেসে ফেলো তাই দূরে দূরে রই!
ক্ষমাই আমাকে কাছে টেনে নিল। নাহলে গরীব, বাপ মড়া চাষার বাড়ির চালচুলোহীন আমার পক্ষে ক্ষমার মতন কারো কাছে যাবার সাহসও হোত না কোনদিন। ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা। কি যে দেখেছিল ক্ষমা আমার মধ্যে কে জানে। কিন্তু ভীষণ ভালবাসত জানেন। কি করে যে এত ভালোবাসা দিয়ে ভগবান নারীদের তৈরী করেন কে জানে! ছোট থেকে মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি, তারপরে এল ক্ষমা। জানেন প্রতিদিন, প্রতিদিন আমার জন্য কিছুনা কিছু খাবার নিয়ে আসতো ক্ষমা, ও জানতো যে সকালে আমি কিছু খেয়ে যেতে পারিনা কলেজে। আমি  ভীষণ অবাক হয়ে ভাবতাম ওই ছোটখাট চেহারার মেয়েটার বুকের ভিতর এত সাহস কি করে! কিকরে আমার মত কপর্দকহীন এক ছেলেকে এতটা ভালোবাসার সাহস পায় ও! কেন এত ভালোবাসো জিজ্ঞাসা করলে বলতো, ভালোবাসি, ভালোবাসি, এত কেন টেনো আমি জানিনা। তারপর বলল, মাণিক আমার, ক্ষমা মাণিকের। আমি মরে গেলেও কেউ আমার থেকে আমার মাণিক কে আলাদা করতে পারবেনা। ওর ওই গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কি বলব, শুধু ভয় পেতাম। একদিন বলেই ফেললেম, তোমার বাবা যদি না মানেন? কি একটা বের করছিল ক্ষমা ব্যাগ থেকে, চোখ তুলে আমাকে বলল, মানবে না তো, কিছুতেই মানবে না, তাই পাশ করার পরেই আমি চলে আসবো তোমার কাছে, তোমার মা আমাকে আশ্রয় দেবেন না? তারপর আবার একটু থেমে বলল, আমি আমার মা কে চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছি মাণিক, আমি তখন ক্লাস সেভেন। ওই শয়তানটা আমার মা কে মেরে ফেলেছে। আমি শুধু অপেক্ষায় আছি, কবে আমি ওই নরক থেকে বেড়িয়ে আসবো। এর বাইরে তুমি আমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞাসা কোরোনা, আমিও বলব না। শুধু আমাকে তোমার বাড়িতে আশ্রয় দিও
আজকে সেই দিন জানেন। আমি একটা স্কুলে চাকরী পেয়েছি, আমাদের গ্রাম থেকে দশ কিলোমিটার দূরে আনন্দপুর গ্রামে। প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারমশাই এর চাকরী। ক্ষমা ওর বাবা কে জানিয়েছে যে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমার সাথে ওর সম্পর্কের কথাও জানিয়েছে। যথারীতি ওর বাবা এই সম্পর্ক কে গুরুত্বই দেন নি। বলেছেন নাকি যে এইসব খামখেয়ালীপনা উনি বরদাস্ত করবেন না, ক্ষমাকে নিয়ে তার অন্য পরিকল্পনা আছে। তমালকে দিয়ে ক্ষমা খবর পাঠিয়েছে যে আজই ও চলে আসবে বাড়ি ছেড়ে। আমি কি পারবো বলুন ওকে সুখী করতে? মা তো ভীষণ খুশী, শুধু বললেন যে ওর বাবা মেনে নিলে ভালো হোত আরো, এক মেয়ে তো, পরে নিশ্চয়ই মেনে নেবে। আমি আসি এখন? পাঁচটা চল্লিশ এর ট্রেন এ ক্ষমা আসবে, আমাকে প্লাটফর্মের ওই দক্ষিণ দিকে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। পাঁচটা চল্লিশ বাজতে চলল প্রায়। ওই ডাউন ট্রেন এই ক্ষমা আসবে। ক্ষমা সেরকমই বলে দিয়েছে। আসি কেমন?
************
ক্ষমা কোনোদিন তার মাণিকের কাছে আসেনি। আসতে পারেনি বলাটাই ভালো। প্রভাবশালী বাবা মেয়ের এরকম বেয়াদপী মেনে নিতে পারেন নি। বাড়ি ছেড়ে পালাবার আগেই ধরা পড়ে যায় ক্ষমা। দুজন ভীষণ বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে সেদিনই মেয়ে কে প্রথমে মুম্বাই, তারপরে দেশের বাইরে চালান করে দেন ক্ষমার বাবা। বিদেশে থাকা কোন আত্মীয়ের কাছে। ক্ষমা এখন নিউ জার্সিতে থাকে। বিয়েও করেছে। ছেলে মেয়েও আছে একটি করে। মাণিক কে তার  মনে আছে কিনা? জানা নেই। কতকিছুই তো কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। কিছু হয়তো পড়ে থাকে মনের গভীরে, অনাদরে, সবার অলক্ষে লুকিয়ে রাখা এক বন্ধ কুঠুরিতে। হয়ত কোন এক উদাস বিকেলে হাইওয়ে দিয়ে ড্রাইভ করে যাবার সময় পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে ওর মনে পড়ে যায় সরল সাদাসিধে নিস্পাপ এক যুবকের মুখ, যে হয়ত তার বুকের সবটুকু কথা উজাড় করে তাকে উপহার দিয়েছিল একটা কবিতা।
************
অনেক বছর আগে মাণিক নামে এই পিপুলতলার এক যুবকের দেহ পাওয়া গিয়েছিল স্টেশনের ওই দক্ষিণপ্রান্তে লাইনের ধারেলোক মুখে কথিত আছে কোনো এক ডিসেম্বরের সন্ধ্যার অন্ধকারে কে বা কারা ছেলেটিকে কুপিয়ে মেরে ট্রেনের লাইনে ফেলে দিয়েছিল। কেউ বা বলে ট্রেনের তলায় কাটা পড়েছিল এক যুবক। সত্যিটা যে কি তা কেউ জানেনা।
কিন্তু আজও যখন আশ্বিন শেষের বিকেলে প্রকৃতি মন খারাপ করা শীতশীতে বাতাসের চাদর মুড়ি দিয়ে ফেলে, দরবেশের খাল এর দিকে পশ্চিম প্রান্তে সূর্যটা অস্ত গিয়ে চারদিক মন উদাস করা ঘোলাটে ম্লান আলোয় ঢাকা পড়ে যায়, ওই দিগন্ত প্রসারিত শূন্যতা থেকে একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝলক বয়ে আসে পরিত্যক্ত প্লাটফর্মের দিকে, পিপুলতলা স্টেশনের দক্ষিণপ্রান্তের ওই বেঞ্চটাতে এক যুবককে বসে থাকতে দেখে কেউ কেউ। সে শুধুই নির্নিমেষ তাকিয়ে  থাকে দক্ষিণ দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া ওই রেল লাইনের দিকে। পাঁচটা চল্লিশ এর ডাউন ট্রেনের প্রতীক্ষায়।

সমাপ্ত।।

Saturday 9 September 2017

তৃষা





অবিশ্রান্ত বারিধারার মত শীতল জলরাশি শাওয়ারের অসংখ্য ছিদ্র পথে নেমে আসছে নগ্ন শরীরের উপর শরীরের ড়া উৎরাই বেয়ে সেই শীতল জলধারা য়ে যাচ্ছে এক অজানা মন উদাস করা শিনশিনে অনুভূতির অবিশ্রান্ত আবেশ ছড়িয়ে শরীরের সব নিভৃত বিন্দুগুলোকে স্পর্শ করে কেউ যেন পরম মমতায় আদর  করে চলেছে তৃষাকে সেই আদরের ছোঁওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তৃষা এই শীতলতার ছোঁওয়ায় সিক্ত হতে হতেও কান মাথা গরম হতে থাকে, তবুও ভিজতে থাকে তৃষা এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় - এইবার বন্ধ হোক ওই বারিধারার উশৃঙ্খল শাসন, বহুদিনের অনভ্যাসে যে ভালোলাগা গুলো বন্ধ জানালার ওপারে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আর এই পথে উঁকি ঝুঁকি মারা বন্ধ করেছিল, তারাই এই নির্জন দুপুরের একাকীত্বের সুযোগে আবার যেন মনের দরজায় কড়া নেড়ে তৃষাকে এলোমেলো করে দিতে চাইছে আর  সেও কেন জানি সেই অবাধ্যতাগুলোকে অবচেতনে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে GSতাই নিজে থেকে শাওয়ারের নব ঘোরাতে পারেনা সে ভিজতে বড্ড ভালো লাগছে আজকে  ভিজতে থাকে তাই তৃষা, ভিজতেই থাকে  
************** 
হঠাৎ চোখ যায় এই আট  বাই আট বাথরুমের পশ্চিম দেওয়ালে ঝোলানো দুই বাই তিন ফুটের আয়নার দিকে শাওয়ারের জল বাস্প হয়ে আয়নাকে ঘোলা করে দিয়েছে সেই ঘোলা কাঁচের মধ্যে নিজের শরীরকে দেখে তৃষা কতদিন আগে কেনা এই আয়না!  বিয়ের ঠিক পরপর খুব লাজুক ভঙ্গীতে দীপকের কাছে আবদার করেছিল তৃষা, "স্নান করে শাড়ি পড়তে আমার খুব অসুবিধা হয় জানো, বাথরুমে একটা আয়না লাগিয়ে দেবে?"
 "তুমিও পারো, এত্ত বড় আয়না কথা বলেছি?", সাতদিনের মধ্যে আয়না লাগানো হয়েছিল, আর নতুন লাগানো সেই আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে দীপক কে বলেছিল তৃষা পিছনে থেকে নিজের সদ্য বিয়ে করা বৌ এর কোমর জড়িয়ে তার কাঁধের উপর থুতনি রেখে ফিসফিস করে তৃষাকে বলেছিল দীপক, "আমার বৌ এর এইটুকু আবদার আমি রাখবো না?" বৌ এর কাঁধে মুখ গুঁজে আদরে ভরিয়ে দিতে দিতে বাম হাত দিয়ে কখন যে শাওয়ারের নব ঘুরিয়ে দিয়েছিল দীপক টেরও পায়নি তৃষা যখন অবিশ্রান্ত জলরাশি ঝরণার মত নেমে এসেছে মাথার উপর তখন সে তার দুই মাসের পরিচিত স্বামীর বাহুডোরে বন্দী নতুন পরিচিত এই শরীরের চাওয়া টুকু আকন্ঠ পান করতে করতে তৃপ্ত হচ্ছিল তৃষা ভালবাসছিল, আর ভালবাসতে বাসতে পূর্ণ হচ্ছিল
আয়না সামনে গিয়ে ভেজা GSহাতেই বাস্পগুলোকে মুছে ফেলে তৃষা বাস্পসৃষ্ট আয়নার অস্বচ্ছতা পুরোপুরি যায় না তবু সেই অর্ধস্বচ্ছ আয়নাতেই নিজেকে দেখে সে কত যুগ পরে নিজের দিকে এমনভাবে তাকালো তৃষা মনেই করতে পারেনা! নিজেকে দেখে আর অবাক হয়ে যায় আবার দেখে, এমনভাবে যেমনভাবে সদ্য কৈশোরের গন্ডী পেরিয়ে যৌবনের দোরগোরা পা রাখা কোনও আকুল প্রেমিক দেখে নগ্নতার বিস্ময় মাধুর্যে অপরূপ হয়ে ওঠা কোনও নারীকে কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করে লাজুক স্তনবৃন্ত দুটি মমতার ছোঁওয়ায় হাতের আঙুল গুলো যেন বলতে চায়, "কতদিন তোদের কেউ আদর  করেনি, তাই না রে?" নাভিমূলের গভীরতা আর গ্রীবার পেলবতাকে বারবার ছুঁয়ে কেমন এক  অদ্ভুত মাদকতা অনুভব করে তৃষা জানুসন্ধির নিভৃত রহস্য স্পর্শ করে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে বহুকাল ধরে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা সকল সংস্কার, সকল  বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য আজ  সে কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, নিজেই বুঝতে পারেনা শাওয়ারের নব আবার ঘুরিয়ে দেয় তৃষা জৈষ্ঠ্যের নিদারুন শুস্ক দিনের পরে শেষ বিকেলের ক্ষণিক ধারাপাত যেমন ঊষর মাটিতে ঝরে পড়ে এক  নৈর্বক্তিক অপূর্ণতা সৃষ্টি করে ঠিক তেমনি এক অব্যক্ত অপূর্ণতার আঘাতে কেঁপে ওঠে তৃষা এই অপ্রাপ্তির গ্লানিতে নিজেকে কেমন দীন মনে হয়, হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক রাশ কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে আসে। নিজের সিক্ত শরীরকেই ড়ে ধরে কেঁদে ফেলে তৃষা শাওয়ারের অবিশ্রান্ত জলধারার সাথে কান্না গুলো মিশে যায়, আর সিক্ত শরীরকে ধুয়ে বয়ে যায় 
সম্বিত ফেরে একটানা বাজতে থাকা কলিং বেলের আওয়াজে। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে। নিজেকে দ্রূত সামলে, কোনরকমে শাড়ীটা গায়ে পেঁচিয়েই বাথরুম থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসে তৃষা
**************
মাস ছয়েক হল দিবাকরের শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হওয়ায়, সবার পরামর্শ মতই দিনের আয়াটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল তৃষা। দু দুটো আয়াকে GS টানা একার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছিল না। দিবাকর এখন সামান্য ভালো। মুখের ভাষা ও হাত বা পায়ের নড়াচড়া সম্পূর্ণভাবে ঠিক হয়নি ঠিকই, কিন্তু প্রথমে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই ভালো। খাটের মাথার দিকে একটা কলিং বেল লাগানো আছে, দরকার হলেই কষ্ট করে তাতে চাপ দিয়ে তার প্রয়োজন জানান দেন দিবাকর। বাথরুম থেকে বেড়িয়েই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল তৃষার। প্রথমে তো ভয় পেয়েছিল, কি জানি কি দুর্ঘটনা ঘটল আবার! ঘরে ঢুকেই দেখে, সারা বিছানা ভেজা, প্রস্রাবের বেগ চাপতে পারেননি পক্ষাঘাতগ্রস্ত তার শ্বশুরমশাইবেডপ্যানটা দেবার জন্যই বেল বাজাচ্ছিলেন তিনি, কিন্তু তৃষার দেরী হয়ে যাওয়ায় বেগ সামলাতে না পেরে বিছানাতেই করে ফেলেছেন। রাগ হয়ে যায় ভীষণ, কিন্তু কি করবে সে, কাকে অভিযোগ জানাবে, কেই বা শুনবে তার দুঃখের কথা! অসহায় বৃদ্ধ শ্বশুরের অপরাধমাখা করুণ চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন মায়াও হয় তার। সত্যিই তো তার কিই বা দোষ! তিনি তো ওকে ডেকেছেন অনেক কষ্ট করে বেল বাজিয়ে, তৃষা যদি দেরী করে তবে তারই বা কি করার থাকতে পারে! একটু আগে তার গা স্পঞ্জ করিয়েই নিজে স্নানে ঢুকেছিল তৃষা আবার শ্বশুরমশাই এর ভেজা লুঙ্গি পালটে, অনেক গলদঘর্ম হয়ে বিছানার চাদর পালটে স্নানে ঢুকল সে। বাথরুম এর মেঝে ভেজা থাকলেই তৃষার মেজাজ গরম হয়ে যায়। একটু আগেই তড়িঘড়ি করে বেরোতে হওয়ায়, সেই কাজটাও বাকি ছিল, আর শাওয়ার চালায়না ও, মগ দিয়ে গায়ে কোনরকমে একটু জল ঢেলেই ফ্লোর ওয়াইপার দিয়ে মেঝের জল টেনে টেনে পরিস্কার করে। টাওয়েল দিয়ে আয়নাটাকে ভালো করে মোছে। আয়নার পরিস্কার কাঁচে নিজের মুখটাকে দেখে। দেখে আর  ভাবে কত দ্রুত সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়, একটু আগে কিভাবে নিজেকে দেখছিল আর এখন কিভাবে দেখছে। একটু আগে ভাবছিল শরীরের কথা, আর এখন ভাবছে, ইস, কত দেরী হয়ে গেল, এখনো পূজো করা বাকি, একটু পরেই মেয়েটা এসে পড়বে।’’ এসব ভাবতে ভাবতেই বাথরুম থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসে সে।
**************
ঠাকুরের আসনের পাশেই একটা ছোট্ট আসনে দীপকের ছবি, খুব একটা দুষ্টু হাসি মাখাnOnoনো মুখে তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে। বিয়ের পরে প্রথম হানিমুনে গিয়ে দেরাদুনের সহস্রধারায় তোলা ছবিটা। ছবিটার দিকে তাকিয়ে আবারো মনে পড়ে যায় অফিসের কলিগ আর পাড়ার বন্ধুদের কাঁধে চেপে দীপকের দেহটার এই বাড়ির সামনের সরু গলি ছাড়িয়ে মোড়ের বড় রাস্তায় দাঁড় করানো ম্যাটাডরের দিকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কিছু আত্মীয়স্বজন ঘরে দীপকের অশীতিপর বাবাকে সামলাচ্ছে, আর বাকি লোকজন আটকে রেখেছে তৃষাকে। তৃষার চোখে একবিন্দু জল নেই, আচমকা এই ঝঞ্ঝাপাতে শরীর ও মনের সব বোধগুলো যেন কেমন প্রস্তরীভূত হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টিতে নেই কোন চেতনা, মনটাও যেন এক লহমায় চলমান রঙ্গিন চিত্র থেকে সাদাকালো স্থিরচিত্র হয়ে গেছে। এমনকি যে দিয়ার দিকে সবসময় কড়া নজর আজ তাকেও দেখে সে দেখছে না। কানেও আসছে না মাঝে মাঝে কান্নার রোল ওঠা বদ্ধ GSআবহাওয়ার মাঝেও ফিসফিস করে বলা আত্মীয়স্বজনের নানারকম কথাবার্তাগুলো। তৃষার মামীর কোলে পাঁচ বছরের দিয়া, কিছুই বুঝছেনা সে। বুঝছেনা, কাল যে পাপা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে প্রমিস করে গেল সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফিরল কেন! আর সাথে এত লোকজনই বা কেন? মাই বা এরকম করছে কেন! একবারও আজ খাবার জন্য জোর করল না, কুট্টিদিদাই তো আজ ভাত খাওয়ালো, একবারও কোলে বসিয়ে আদর করলো না, স্নান করালো না, সাজিয়ে দিলনা, টিপ পড়ালো না! তৃষা সেদিন কি করছিল, আশেপাশে কেই বা ছিল, কিই বা বলছিল কিচ্ছু মনে নেই আজ
**************
একটা প্রাইভেট কোম্পানির বড় পদে চাকরী করতো দীপক। অফিসের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার কারণে এটাই শোনা গেছিল যে কোম্পানী তৃষা ও তার মেয়ের কথা ভেবে তাদের সংস্থায় একটা চাকরীর ব্যবস্থা করবেশোকের পর্ব মিটে যেতে আস্তে আস্তে বাড়িতে অফিস কলিগদের আনাগোনা কমতে থাকল। কোন এক দুর্বোধ্য কারণে তৃষার চাকরীটা দীপকের কোম্পানীতে হল না। কোম্পানী নানা অজুহাতে তাদের ওই প্রতিশ্রুতি থেকে পিছিয়ে এল। নিজস্ব পাওনা বাদে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে কোম্পানী তার দায় এড়িয়ে গেল। একদিকে স্বামী হারাবার যন্ত্রণা, শ্বশুরবাড়িতে একা দীপকের বৃদ্ধ বাবা, যিনি ছেলের অকাল মৃত্যুতে প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে আছেন, কথা প্রায় বলেনই না, তাকে সঙ্গ দেওয়া, অন্যদিকে পাঁচ বছরের শিশু কন্যা। কোন দিক সামলায় তৃষা! দিয়ার মুখে হাজারটা প্রশ্ন, তার পাপাকে নিয়ে। পাপাকে ওরা কেন নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল? কখন পাপা ফিরে আসবে? মেয়েকে অজস্রবার বলা মিথ্যার জাল থেকে যেন বেরোতে পারেনা তৃষা। চোখ ফেটে জল আসে, অথচ মেয়ের সামনে সেই জলকে চোখেই আটকে ফেলতে হয়, পাছে মেয়ের মনের উপর তা কোন বিরূপ রেখাপাত করে।
শোকটা যেন একটা ঝড়ের মত, ঝড় চলাকালীন লোকে ঝড়ের তান্ডবটাই দেখে, কিন্তু ঝড় কেটে গেলেই বোঝা যায় যে চারদিকে কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দীপকদের এই দোতলা পৈত্রিক বাড়ির নীচতলাতে ভাড়া ছিল আগেইসেই দুর্দিনে বোঝা গেল যে এই ভাড়ার টাকা কয়টাও কত জরুরী। নিজের বাড়িতে মা আর বাবা। কাকারা শুধু আছে মাত্র। নামেই। তারা GSএসে যে পাশে দাঁড়াবে তার আশা নেই, উপায়ও। এদিকে বাবার নিজের শরীর ভালো না, সামান্য পেনশনের টাকায় সংসার চলে, তবুও চোখের জল সামলে তিনি বললেন, তুই মনে করলে আমাদের এখানে এসে থাক মা তৃষা শুধু বলতে পেরেছিল, শ্বশুরমশাইকে একলা ফেলে তোমার কাছে কি করে চলে আসব বাবা, তাহলে ওঁর আত্মা কি শান্তি পাবে?’’
 শোক!! শোক!! কিসের শোক! শোকের পাথারে অবগাহন করেও কারো কারো জীবনে শোক করার অবকাশও মেলেনা! সদ্য বিধবা একটা সাতাশ আঠাশ বছরের যুবতী নারীর নিজের স্বামীর জন্য দুঃখ করার অবকাশ পৃথিবী দেয়নি, তার আগেই তার মাথার উপর চেপে বসেছে সংসারের হাজার দায় দায়িত্ব, কর্তব্যের ভার। কথায় বলে যখন খারাপ সময় আসে তখন সে একা একা আসেনা, সাথে অনেক সঙ্গী সাথীকেও নিয়ে আসে। দ্বিতীয় আঘাতটা আসলো দীপক চলে যাবার ছয় মাসের মধ্যে। স্বামীহারা হবার দগদগে ঘা টা তখনো বুকের মধ্যে তরতাজা, সেই নিদারুণ কষ্টের দিনে জীবনকে টালমাটাল করে দেবার আঘাতটা আসলো একদিন রাত্রে যখন দিবাকর, দীপকের বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হল। প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীরের বাম দিকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেল। প্রায় একমাস শহরের বড় নার্সিং হোমে কাটিয়ে চলৎশক্তিহীন দিবাকর ফিরে এলেন বাড়িতে। কেন্দ্রীয় সকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হওয়ায় চিকিৎসার খরচের সিংহ ভাগ সরকার বহন করলেও বাড়ি ফেরার পরে শুরু হল মূল সমস্যাদিনে রাতে দু জন আয়া, রুগীর পথ্যের খরচ, সব মিলিয়ে বিরাট আর্থিক চাপ এসে উপস্থিত হল। GSএতদিন তো দিবাকর এর পেনশন দিয়ে, বাড়ি ভাড়া দিয়ে সবকিছু ভালো মতই ম্যানেজ করছিল তৃষা, কিন্তু এই ঘটনার পর রীতিমত সমস্যা শুরু হল। আর্থিক সমস্যা। দুঃখ করে চোখের জল ফেলার জন্যেও সময় লাগে। তৃষা জীবনে সেই সময়টাও এতদিনে পায়নি। দুঃখ করলে কেঁদে ভাসালে তার ছোট মেয়েকে কে দেখবে, কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে, কে ই বা তার জন্য খাবার রান্না করে দেবে। কে ই বা ঘুম পাড়াবে! বুকে পাথর চাপা দিয়ে, চোখের জলকে লুকিয়ে ফেলে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়তে হয়েছে কোমর বেঁধে। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে এই দুঃখের দিন গুলোই মানুষ চেনায়। তৃষাও চিনেছে। বন্ধুদের চিনেছে, আত্মীয়স্বজন দের চিনেছে। বড় মামার অত্যন্ত আদরের পাত্রী ছিল সে। মামা আর বড়মামী শুধু তাদের এই দুঃখী ভাগ্নীর জন্য জানপ্রাণ লড়িয়ে দিয়েছিলেন। মামা সুপ্রতিষ্ঠীত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। টাকাপয়সার দরকার হওয়ার আগেই তৃষার হাতে টাকা পৌঁছে যেত। কিন্তু তৃষারও আত্মসম্মান আছে। মামা দিচ্ছে বলেই হাত বাড়িয়ে নিতে হবে, এই মানসিকতা নিয়ে তো সেও বড় হয়নি, তাই একদিন কষ্ট করে মামাকে বলেই ফেলল, মামা, তুমি অনেক করেছ, আর কত করবে? এবার আমাকে কিছু করতে দাও। তোমরা তো রইলেই বিপদে আপদে সবসময়।’’ তীব্র আপত্তি জানালেন মামা। বললেন, তোমার বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ, তোমার মেয়ে ছোট, তাকে বড় করে তোলাও তোমার দায়িত্ব, এখন এই মুহূর্তে তোমাকে বাইরে টাকা উপার্জন করতে যেতে হবেনা। তাহলে সবদিক ওলটপালট হয়ে যাবে। মেয়ে বড় হোক একটু, তোমার বাড়ির পরিস্থিতি পাল্টাক একটু, আমি তোমাকে বাঁধা দেবো না।’’ মামার কথায় যুক্তি ছিল। সেই কথামতই চলেছে তৃষা অনেকদিন।
আর ছিল সুপ্রতীম। দীপকের বন্ধু। ছাত্র জীবনের। বিয়ের পর থেকেই দেখেছে যে দীপকের এই বন্ধুর সাথেই ঘনিষ্ঠতা সবচেয়ে বেশীনিজের পৈতৃক রঙের ব্যাবসা। দীপক থাকাকালীন মাঝে সাঝে এই বাড়িতে আসলেও দীপক চলে যাবার পর যেন অযাচিত ভাবেই এই সংসারের অনেকটা দায়িত্ব সুপ্রতীম নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিল। মা বাবা, মামা মামী আর কতক্ষণ পাশে থাকতে পারতো! সকাল বিকেল, দিন রাত সবসময় সুপ্রতীম অসহায় এই পরিবারের পাশে থাকার সাহস দেখালো। GSএই সমাজে কেউ কারো ভালো না করতে পারলেও স্বাভাবিকের থেকে অন্যরকম কিছু ঘটলেই সবজান্তা বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাউকে প্রকাশ্যে কদর্য করার লোভও অনেকে সামলাতে পারেনা।  যেন দারুণ মুখরোচক কিছু একটা পাওয়া গেছে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে চায়ের কাপে তুফান তোলার জন্য! এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু হলনা। পাড়াপ্রতিবেশীর কিছু কানাঘুষো, বন্ধুবান্ধব, কাছের দূরের আত্মীয়স্বজনের কিছু তির্যক মন্তব্য শনা গেল। কিন্তু জীবনের চরম ঘাত প্রতিঘাতের ওঠানামায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া তৃষার এইসব কানাঘুষোতে তখন আর মন খারাপ করেনা। সে জানে যে সে একা, আর সেই একা যুদ্ধটাকে লড়তে সে যাকে পারবে সঙ্গে নেবে, যার সঙ্গে পারবে পথ চলবে তার হৃদয় জানে যে সে কি করছে। সুপ্রতীমরাও এখানকার পুরনো বাসিন্দা, তার উপরে জনসেবার কাজে তার ব্যস্ত থাকার কারণেই হোক কিংবা নিজের ভালোমানুষ ইমেজের জন্যেই হোক বা পারিবারিক সুনামের কারণেই হোক- কেউ প্রকাশ্যে কিছু অসভ্যতা করার সাহস পেতো না। তবুও দু একটা কথা কি মাঝে মাঝে ভেসে আসতো না তৃষার কানে? আসতো, কিন্তু ততদিনে সে শিখে ফেলেছে যে কোনও কথাকে মনে রেখে তার সংসার চলবে না, তার মেয়ের ভবিষ্যত তৈরী হবেনা। পাশাপাশি মা আর মামা মামীর অকুন্ঠ সমর্থন ছিল ওর দিকে। একমাত্র ওঁরাই মনে রেখেছিলেন অন্যের কাছে বাসী হয়ে যাওয়া ওর দুঃখের কথা। মাঝে মাঝে মামা ঠারে ঠোরে আবার সংসার করার কথা তুলতেন আমতা আমতা করে। বলতেন, এইভাবে কি সারা জীবন চলবে মিমি? আজ নাহয় আমরা আছি, আমরা যখন থাকবো না তখন কি হবে?’’ তৃষা একবারের জন্যেও বলতো না, এক বাচ্চার মা বিধবা এই দুর্ভাগা মেয়েকে কে বিয়ে করবে মামা?’’ এটা সত্যি ঘটনা সেটা কি সে জানে না, তবু ভয় হত। বিয়ে? আবার? আবার নতুন করে ভাগ্য পরীক্ষা! তাও এক মেয়ের মা হয়ে? সেখানে যদি আরো কিছু ব্জ্রপাত অপেক্ষা করে থাকে তবে সে কোথায় দাঁড়াবে! এখানে তো বদ্ধ দরজার মধ্যে একলা ঘরে নিভৃতে চোখের জল ফেলা যায়, যদি GS এই সামান্য বিলাসিতাটুকুও অন্য কোথাও কেউ ছিনিয়ে নেয় কেউ, বাঁচবে কি করে সে? সবার উপরে রয়েছে বাবা, তার শ্বশুরমশাই। কি করে সে এই অসহায় মানুষকে ছেড়ে চলে যায় শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা, ভবিষ্যতের কথা ভেবে? সেই বাক্যহীন, চলৎশক্তিহীন, একটা ঘরে মরা মানুষের মত পড়ে থাকা নির্জীব মানুষটার প্রতি তার কোন কর্তব্য নেই? দ্বন্দ আর দোলাচলের দোলায় দুলতে দুলতে কোন হিসাব কারো মেলেনা, তাই প্রশ্ন করাও বন্ধ হয়ে যায়। সবাই যেন মেনে নিতে বাধ্য হয় যে এই দুর্ভাগ্যের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান কারো হাতে নেই, তাই সবাই চুপ হয়ে যায়, মেনে নিতে শেখে যা ভবিতব্য তাকে।
 সুপ্রতীমের স্ত্রী চিররুগ্ন, হাজারটা রোগে ভুগতে ভুগতে কিছুটা মানসিক রোগগ্রস্তও, তাদের নিজের কোন সন্তানাদি নেই, তাই হয়ত দিয়াকে নিজের সন্তানের অধিক স্নেহ করে সুপ্রতীম। স্বামীর অবর্তমানে তার বন্ধুর এই বাড়িতে আসা যাওয়া নিয়ে বাবা ও মামার একটু আশঙ্কা ও মৃদু আপত্তি থাকলেও বড়মামী ও মায়ের তরফে কোনও প্রশ্ন ছিলনা, ছিল প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়আস্তে আস্তে বাবা ও মামার চোখেও সুপ্রতীম এর অবস্থান টা স্বাভাবিক হয়ে উঠল। স্বাভাবিক সম্পর্কের বন্ধনের বাইরে থেকেও সুপ্রতীম পরিবারেরই একজন হয়ে উঠল। তৃষাও কেমন অবাক হয়ে যায় ভাবলে। যে মানুষটা তার স্বামী বেঁচে থাকার সময়ে তার সাথে সম্ভ্রম বজায় রেখে চলা এক বন্ধুপত্নীর চেয়ে বেশী বিন্দুমাত্র চারিত্রিক GS স্খলতার আভাস অবধি দেয়নি, স্বামীর দীর্ঘ অবর্তমানে সেই মানুষই কি করে তার, এই পরিবারের সবচেয়ে ভরসার মানুষ হয়ে গেল! নারী কি তবে এই ভরসা প্রত্যাশা করে? অথচ সুপ্রতীম এই পাঁচ ছয় বছরে একবারের জন্য ও কোন ইঙ্গিত এমন দেয়নি যাতে মনে হবে যে সে একজন অসহায় নারীর দুর্বলতার সুযোগে তার থেকে কিছু অতিরিক্ত প্রত্যাশা করছে। বরং প্রতি বছর ২৩শে জুলাই মনে করে দীপকের ফটোতে মালা দিতে ভুল হয়না সুপ্রতীমের। দিয়ার সাথে তার আচরণ সম্পূর্ণ বাবা মেয়ের, বস্তুত বাবার অভাব সে দিয়াকে অনুভব করতেই দেয়নি। শিশুর মত সে দিয়ার সাথে আচরণ করে, দিয়াকে তৃষা বকলে সুপ্রতীম কষ্ট পায়, কখনও হাল্কা প্রতিবাদ করে। যদিও তৃষার মুখের উপর জোর করে বেশী কিছু বলতে পারেনা।
কেন পারেনা? এমনিতে সুপ্রতীম অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা, কোনো সমস্যার সমাধান করতে সে তার বিচক্ষণতার ছাপ রেখে যায় এমনভাবে যে সবাই তার মতামতকে সমীহ না করে থাকতে পারে না। সেই অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত সুপ্রতীমই তৃষার সামনে কেমন যেন কুঁকড়ে থাকে। কেন? উত্তর পায়না তৃষা। সুপ্রতীম কি তৃষাকে ভয় পায়? এখনও বোঝেনা সে। কে সে সুপ্রতীমের? নিজের জীবন নিয়ে তো কখনো কিছু বিশেষ বলতে শোনেনি ওকে, কিন্তু মেয়েমানুষের মন ঠিক বুঝতে পারে যে সুপ্রতীম সুখী নয়। কিছুতেই নয়। তার স্ত্রী রুগ্ন, স্বামীকে জাগতিক সুখ দিতে অসমর্থ বলে নয়, তার মনের সাথে সুপ্রতীমের কোনো মিল নেই, বরং বলা চলে প্রতি বিষয়েই এই মনের অমিলকে নিয়েই নিত্য অশান্তি ওর জীবনের নিয়মনানা ঘটনা, নানা পরোক্ষ কথার সুত্র মিলিয়ে তৃষা এটা বুঝেছে যে সুপ্রতীম আর তার স্ত্রী প্রভার সম্পর্ক শুধুমাত্র বন্ধনহীন এক দায় মাত্র। কিন্তু এগুলো সুপ্রতীম তার কাছে গল্প করে সহানুভূতি আদায় করার জন্য বলেনি কখনো। তৃষা বুঝেছে। কিন্তু সে-ই বা এত ভাবছে কেন তার কথা? তবে কি সুপ্রতীম নীরবে GS তার মনে কোন ছাপ ফেলে যাচ্ছে? এই সাহচর্য, এই বন্ধু কিংবা অভিভাবকের চেয়েও অধিক হয়ে পাশে থাকা, নীরবে ভরসা দেওয়া উপস্থিতি দিয়ে জানিয়ে যাওয়া যে, ভয় নেই, আমি আছি- এগুলো কি তবে সুপ্রতীমকে তার মনের মধ্যে কোনও আসনে উপবিষ্ট করাচ্ছে তার অজান্তেই? অধিকারবোধ তৈরী করে ফেলছে তার মনের মধ্যে? তৃষা কি মনের অগোচরেই সুপ্রতীমকে নিয়ে ভেবে ফেলছে! কেন? একটু আগে বাথরুমে স্নান করতে করতে সে কি তবে দীপকের জায়গায় সুপ্রতীমকে ভাবছিল? পূজো করতে করতেও চিন্তার স্রোত বয়ে যায় তৃষার মনের ভিতরে। ভাবনাগুলো কেমন যেন জট পাকিয়ে যেতে থাকে। এ কি পাপ? যদি এমন চিন্তা আমার মনে আসেও সে কি পাপ?’’ নিজের কাছেই এই প্রশ্ন করে সে, উত্তর পায়না, উথালপাতাল হতে থাকে তৃষার মন।
**************  
দীপকের ছবির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে তৃষার। কোথায় গেলে তুমি আমাকে একলা ফেলে? কেন গেলে? একলা আমি কিভাবে সবকিছু সামলাবো, দিয়া কে কি ভাবে মানুষ করবো? বলে দাও আমাকে। আমি কি মানুষ নই, আমার শরীর, মন বলে কিচ্ছু নেই?  না কি আমি অভাগী বলে আমার কোনো জাগতিক চাহিদা কিচ্ছু থাকতে নেই?’’ পিতলের গোপালের মাথায় চন্দনের টিপ পড়াতে পড়াতে চোখের কোণা ভিজে আসে তৃষার। রাশি রাশি চিন্তা ভীড় করে আসে মনের মধ্যে। মনে মনেই গোপালের উদ্দেশ্যে বলে, ঠাকুর, কোনো দায়িত্ব পালন করা থেকে তো আমি পিছিয়ে আসিনি, জ্ঞানতঃ আমি কোন অন্যায় করিনি, আমি নিজের সুখের দিকে তাকাইনি কখনও, তুমি আমাকে যে কষ্টই দাওনা কেন আমি আমার কর্তব্য করে যাচ্ছি। তবে আমার মন কেন আজ শরীর চাইল? কেন GSতুমি আমার এই শরীরের মধ্যে বসে থাকা ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে তুললে। আমি তো সব ভুলে বেশ ছিলাম। তবু আমাকে পাপের ভাগী কেন করছ ঠাকুর! আমার এত পরীক্ষা কেন নিচ্ছ? আমাকে পাপের ভাগী কোরোনা ঠাকুরআমাকে পথ দেখাও।’’ নিজের মনের সবটুকু জটিল জিজ্ঞাসা হাস্যময় গোপালের মূর্তির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পথ খোঁজার চেষ্টা করে তৃষা।
বেলা বয়ে যায়। সামান্য বাকি থাকা টুকটাক সাংসারিক কাজ করা আর হয়ে ওঠেনা। ভুলে যায় যে দিয়ার স্কুল থেকে ফেরার সময় এসে গেছে। ডোরবেলের আওয়াজে চমকে ওঠে তৃষা
**************
দরজা খুলতেই একটা দমকা বাতাসের মত ঘরে ঢোকে দিয়াকাঁধের ব্যাগটাকে সোফার উপর ছুঁড়ে ফেলেই মার গলা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ আদর করে মাকে। ক্লাস ফাইভে ওঠা কিশোরী মেয়ের স্কুল ফেরত ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীরেও যে পবিত্র সুবাস থাকে সেই সুবাসে নিজের মনের চঞ্চলতাকে ধুয়ে ফেলতে চায় তার মা। হঠাৎ চোখ যায় দরজার দিকে। এই দরজাই নীচের তলাকে তাদের উপরের তলা থেকে পৃথক করে রেখেছে। এতক্ষণ মেয়ের আদরের চোটে দরজার দিকে খেয়ালই পড়েনি, এখন চোখ পড়তে দেখে যে দরজার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের মা ও মেয়ের এই আদরের নয়নাভিরাম দৃশ্য অপলক নয়নে দেখে যাচ্ছে সুপ্রতীম। মনে পড়ে যায় যে আজকে ওর পুল কারের ড্রাইভার সকালেই ফোন করে জানিয়েছিল যে আজ কোন একটা কারণে সে ফেরার সময় আসতে পারবে না, তাই অগতির গতি সুপ্রতীম কেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দিয়া কে স্কুল থেকে ফেরত আনার। মনের চঞ্চলতার কারণে ভুলে গেছিল তৃষা, তাই এখন তাদের মা মেয়ের এই নিভৃত ভালবাসার দৃশ্য সুপ্রতীম দেখে ফেলার কারণেই হোক, GSকিংবা একটু আগে মনের ভিতরে ঘটে চলা ঝড়ের কারণেই হোক, ওর উপস্হিতি কেন জানিনা মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয় তৃষার। দিয়াকে কোল থেকে সরিয়ে বিসদৃশ চীৎকার করে বলে ওঠে, হল তো, দিয়া তো ঘরে পৌছে গেছে, তবে আর ওখানে সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকার কি হয়েছে, যাও বাড়ি যাও।’’ আকস্মিক এই চীৎকারে চমকে ওঠে দিয়া। আমতা আমতা করে মা কে কিছু বলতে যায়। সুপ্রতীমও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠে, কিছু হয়েছে তৃষা?’’
-না, কিচ্ছু হয়নি, তুমি দয়া করে এসো এখন।’’ বলেই দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় তৃষা। বিছানায় শরীরটাকে ছুড়ে ফেলে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে। সুপ্রতীম ও কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। যাবার সময় শুধু দিয়াকে বলে যায়, দরজাটা ভেজিয়ে দে তো মা।’’
**************
বাইরের ঘরের সোফায় বসে অস্থির ভাবে আজকের খবরের কাগজে চোখ বলাচ্ছিল সুপ্রতীম। যে শঙ্কিত ভাব ওকে সবসময় তৃষার সামনে কুঁকড়ে রাখে সেই ভাব এখনও ওর চোখে মুখে, রান্নাঘরে চা করতে করতে ঠিক খেয়াল করে তৃষা। আজ সাতদিনের মধ্যে এই প্রথমবার এলো সুপ্রতীম, সেদিনের সেই ঘটনার পর। দিয়া স্কুলে যাবার পর নিজেই ফোন করে সে সুপ্রতীমকে, বলে, তোমার সাথে কিছু কথা আছে..., বাকিটুকু শোনার আগেই ফোন কেটে দেয় তৃষাকে অবাক করে। GS একটু পরে নিজেই ফোন ব্যাক করে বলে, বাড়িতে ছিলাম, প্রভা সামনে ছিল, তাই ফোনটা তখন কেটে দিয়েছিলাম, বল, কি হয়েছে?
-কেন প্রভা কি আমি ফোন করলে তোমার উপর চোটপাট করে? আমিতো সচরাচর তোমাকে ফোন করিনা!’’
-অকারণ অশান্তি বাড়িয়ে লাভ কি? প্রত্যেকেই নিজের বুদ্ধি অনুযায়ী সবকিছু ভাবে, শত চেষ্টাতেও তাদের মানসিকতা পরিবর্তন করা যায়না, আর সেই চেষ্টা করাটাও বোকামি। ছাড় এসব, বল কেন ফোন করেছিলে?
অকারণ কথা বাড়ায় না তৃষা, বলে, সময় করে একটিবার আসবে?’’
-কিছু হয়েছে?
-এসো না! এখনো রেগে আছো?’’
-কি হয়েছে তোমার? কাকাবাবুর কোনও কিছু বাড়াবাড়ি হয়েছে?
-কেন, আমি আমার দরকারে ডাকতে পারিনা তোমায়, প্রতীমদা?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে সুপ্রতীম, না না, তা কেন?
-একবার এসো প্লিজ, সময় নিয়ে এসো পারলে।’’
চা টা নিয়ে ড্রয়িং রুমের কাছে গিয়ে সুপ্রতীমের GS পাশের সিঙ্গল সোফাটাতে বসে তৃষা। চা এর সাথে চিড়ে ভাজার প্লেট টা এগিয়ে দিয়ে বলে, সকাল থেকে তো কিছু খাওয়া হয়নি বোধ হয়? এটা আগে খেয়ে চা টা খাও।’’ দীপক চলে যাবার পর এমন ভাবে কথা বলেনি কোনোদিন তৃষা, তবু তার আজকের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া রূপ দেখে একটু সাহস করে বলেই ফেলল, আজ হঠাৎ আমার খাওয়ার খোঁজ নিচ্ছ যে বড়!
-এতদিন করিনি বলে আজ যদি করি সেটা ভুল?’’
-না ভুল নয়, তবে অভ্যাস নেইতো, তাই একটু অবাক হয়েছি আর কি।’’
-তুমি আমাকে খুব স্বার্থপর ভাবো তাই না প্রতীমদা?
-তোমাকে আমি কি ভাবি সেটা কি জানা খুব জরুরী, তৃষা?
সুপ্রতীমের কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তৃষা বলে ওঠে, ও চলে যাবার পর আমরা যে অকুল পাথারে পড়েছিলাম তাতে তুমি না থাকলে  আমাদের কি হোতো বলত?
-আমি আমার কর্তব্য করেছি শুধু। আর সেটাও বিরাট কিছু একটা ব্যাপার নয়। GS মানুষের এটুকু করা দরকার। নাহলে কিসের বন্ধু?
-এরকম তো কতজন ছিল, সবাই কিন্তু করেনি।
-কে কি করেছে তার খোঁজ আমি রাখিনা, আমি শুধু আমারটার খবর রাখি।
-তুমি যা করেছ, যা করে যাচ্ছ তা শুধু তোমার বন্ধুত্বের খাতিরে? আর কোন দায় নেই, কোন টান নেই?
চুপ করে যায় সুপ্রতীম। অনেকক্ষণ থেমে আস্তে আস্তে বলে, সব প্রশ্নের উত্তর হয়না তৃষা। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাওয়াটাও বোকামি।
-চা টা খেয়ে নাও প্রতীমদা, ওটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
-হ্যাঁ খাচ্ছি। বলে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বলে, কিন্তু আজ হঠাৎ এমন কঠিন কঠিন প্রশ্ন করছো কেন তুমি? কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?’’
-কেউ কিচ্ছু বলেনি। সবসময় তো তোমার থেকে নিয়েই এসেছি, আজ তুমি আছো বলে দিয়ার জন্য আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু
-দিয়াকে আমি আমার মেয়ের থেকেও উপরের এক স্নেহের জায়গায় রাখি। সেটা কেন, তা আমি ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবোনা। সব মানুষেরই হয়ত কিছু না কিছু এমন জায়গা থাকে। আমার নিজের সন্তান নেই বলেই আমি দিয়াকে এত ভালোবাসি, সম্পর্কটা এত সহজ সমীকরণ নয় তৃষা। ওই যে বললাম একটু আগে, সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেই
-দিয়া তোমার কাছে কি সেটা আর কেউ না জানুক, আমি জানি প্রতীমদা।
-দিয়া আমার সবটুকু তৃষা, আমার হৃদয়, আমার- আমার প্রাণ
-আর আমি?
ঘরের মধ্যে যেন হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক হয়, চমকে ওঠে সুপ্রতীম। এ কোন তৃষা! এই তৃষাকে তো সুপ্রতীম চেনেনা। দশ বছরের উপর দেখছে এই নারীকে, বহু ঘটনার GS সাক্ষী সে। সুখের দুঃখের। যে নারীকে একটা গন্ডীর বাইরে কোনোদিন আজ অবধি সে দেখেনি, যার চারদিকে ব্যক্তিত্বের এক অদৃশ্য আচ্ছাদন তাকে আর একশো নারী থেকে পৃথক করে রাখে, যে নারীকে তাই সে চিরকাল অসূর্যস্পর্শা ভেবে মনে মনে তার জন্য এক দেবীর আসন গড়েছিল, সেই নারীই আজ তাকে কি প্রশ্ন করে বসছে? তৃষা কি কিছু আন্দাজ করে কথাগুলো বলছে? সংশয়ে পড়ে যায় সুপ্রতীম। কোনো উত্তর দিতে পারেনা তৎক্ষণাৎ। চোখ নামিয়ে ফেলে। অনেকক্ষণ বাদে আবার চোখ তুলে অবাক হয়ে যায় সে। এই দৃষ্টি তো আগে কোনোদিন দেখেনি সুপ্রতীম, এইরকম শান্ত অথচ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! যেন মনের গভীরে সযত্নে বন্দী করে রাখা সব গোপনীয়তাকে পড়ে ফেলতে পারে এই দৃষ্টি! চোখের দৃষ্টি একটুও না সরিয়ে আবার বলে তৃষা, আমি?
-আমাকে নিজের কাছে অপরাধী কেন বানাচ্ছ তৃষা, কি অপরাধ করেছি আমি?
যেন সুপ্রতীমের আগের কথা কিছু শুনতে পায়ই নি তৃষা এমন ভাবে আস্তে অথচ দৃঢভাবে বলে উঠল, ভালবাসোনা তুমি, আমাকে?
 অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সুপ্রতীম। মুখ নীচু করে। তারপরে নিজের মাথাকে বুকের সাথে প্রায় মিশিয়ে স্বগতোক্তির স্বরে বলে ওঠে, বাসি।
-কোনোদিন মুখ ফুটে বলোনি কেন?
ঘরে পিন পড়লেও সেই শব্দ পাওয়া যাবে GS এমন নিস্তব্ধতা, শুধু মাথার ওপরে ফ্যানটা হাল্কা আওয়াজ করে ঘুরছে। আবারো বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে সুপ্রতীম। তারপর আস্তে বলে ওঠে, বলতে পারার মত অবস্থানে আমি নেই তৃষা। চোখ বুজলেই আজো দেখতে পাই এই গলি দিয়ে আমরা আমাদের বন্ধুর মরদেহ নিয়ে যাচ্ছি, আর তার বউটা পাগলের মতন আলুথালু হয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসছে আমার বন্ধুটাকে তোমরা নিয়ে যেওনা বলতে বলতে! আমি শত চেষ্টাতেও ওই দৃশ্য মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি তৃষা যে বন্ধুকে নিজে কাঁধে করে নিয়ে শ্মশানে গেছি, তার বউকে তারই দীর্ঘ অবর্তমানে বলতে পারি ভালোবাসি তোমাকে? মনে হবে না আমার যে কি বীভৎস তঞ্চকতা করছি নিজের বন্ধুত্বের সাথে? আজ একটা কথা স্বীকার করি তোমার কাছে। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি দীপকের পাশে সেদিনও এক ভালোলাগা তৈরী হয়েছিল, সেটা ছিল ভালোলাগা। GSঅনেকে ভাবে কাউকে ভালোলাগা মানেই নিজের করে চাওয়া, ভালোলাগা মানেই পাপ। আমি ভাবিনা। সেদিনও ভাবিনি। যতক্ষণ না আমার মনের কলুষতা বাইরে প্রকাশিত হয়ে সেই ভালোলাগাকে কদর্য করছে ততক্ষণ সেই ভালোলাগা পাপ নয়। সেই ভালোলাগায় এক ধরণের মুগ্ধতা মিশে ছিল। তারপর  বন্ধুর অবর্তমানে তার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়েও তোমাকে দেখেছি। প্রতিনিয়ত। ভীষণ কাছে থেকে দেখছি। বিগত ছয় বছরে তোমাকে এইভাবে দেখে তোমার প্রতি আমার মাথা শ্রদ্ধায় ঝুঁকে আসে। সেই শ্রদ্ধা কখন যে ভালোবাসা হয়ে গেছে আমি বুঝিনি তৃষা। মনে হয়, কিছুতেই যেন তোমাদের উপর কোন আঁচ না আসে, আমি যেন এইটুকু চীরকাল করে যেতে পারি। তোমাদের না দেখলে আমি একদিন ঠিক থাকতে পারিনা, মনে হয় সবাই ভালো আছে তো? য়ালাদা করে তোমার কথা ভাবলেই আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি তো জানি, নিজের সুখ এর কথা চিন্তা না করে তুমি কি করে চলেছ এই সংসারের জন্য, দিয়ার জন্য, কাকাবাবুর জন্য! আমার খুব কষ্ট হয় তৃষা। মনে হয় জীবনের সামান্যতম সুখও কি দিতে পারি না এই নারীকে? প্রশ্ন করি নিজেকেই কিন্তু কোন উত্তর পাইনা। GS
এতটুকু বলে থামে সুপ্রতীম। অবাক বিস্ময়ে প্রতীমকে দেখে তৃষা। বলে, এমনভাবে ভাবো তুমি আমায় নিয়ে? এতটা ভাবো? তবুও সাহস করে একটি বার মুখ ফুটে বলতে পারলেনা সেই কথা?
-সব কথা মুখে বলতে নেই তৃষা। কি বলবো তোমায় আমি? আমি বিবাহিত, আমার বিবাহিত জীবন যেমনই হোক, সমাজের চোখে আমার স্ত্রী আছে, দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা হয়েও ঝামেলাহীন ভাবে জীবনটাকে যে যার মতন কাটানো যায় সেটা আমি জানি, তবু তা আমার জীবনে হবার নয়। কেউ কেউ এক মেরুর বাসিন্দাকে জোর করে অপর মেরুতে টেনে আনতে চায়। পারেনা। নিত্যদিন তাই আমাকে নানারকম অশান্তি পোয়াতে হয়সেটা বাইরে বলে কি হবে? সবাই ভাববে, আমার নিশ্চয় চরিত্রের দোষ আছে। তাই আমাকে বাইরের জগতের কাছে দারুণ ভালো আছি এই অভিনয় করে যেতে হয়। GS আর এই জট পাকানো জীবন কে সাথে নিয়ে এসে তোমাকে বলতে পারি আমার মনের গভীরে জন্ম নেওয়া অনুভূতির কথা? কি ভাববে তুমি? ভাববে না যে তোমার পাশে দাঁড়াবার অছিলায় আমি মনের ভিতর বদ উদ্দেশ্য নিয়ে আসছি তোমাদের কাছে? আমাকে তুমি ঘৃণা করবেনা? তোমার চোখে ঘৃণার পাত্র হয়ে থাকবো আমি তৃষা? যাকে মনে মনে ভালোবাসি তার চোখে বাস্তবিক ছোট হয়ে বেঁচে থাকা কোনো বেঁচে থাকা?  তুমিই বল? সবার শেষে, কিন্তু সবার উপরে, আমার এই সামান্য চাওয়াটুকুর জন্য যদি আমি দিয়াকে হারাই, তা যে আমার মৃত্যুর সামিল হবে। বাবা হয়ে এই কাজ আমি করতে পারি?
একটানা কথা বলে থামে একটু সুপ্রতীম। নিঃশ্বাস নেয়। তৃষা অবাক বিস্ময়ে দেখে সুপ্রতীমকে। দেখে আর অবাক হয়।
-যদি আমি বিবাহিত না হতাম, তখন এত বছর বাদে তোমাকে স্ত্রী হিসাবে চাইতে আমার কুন্ঠা কম হত। কিন্তু নিজের সুখের জন্য একজন অসুস্থ স্ত্রীকে ত্যাগ করাটাও কোনো সঠিক কাজ নয়। নাই বা থাকলো সামান্য মনের মিল। সেটা অন্যায় হবে। আমি একটা জিনিস বুঝেছি তৃষা। GS এক জনমে সবকিছু পাওয়া যায়না। কেউ কেউ আবার একটু বেশী দুর্ভাগা। আমাদের মতন। এই জন্মে আমাদের সংসার সুখ নেই। আমি জন্মান্তর মানিনা, তবু যদি আবার কোন জন্ম পাই তবে চাইবো তোমাকে আর আমার দিয়াকে নিয়ে যেন সংসার হয় আমার
এইটুকু বলে আবার থামে সুপ্রতীম। ঘরের মধ্যে আবার অখন্ড নীরবতা বিরাজ করে। বেশ কিছুক্ষণ থেমে তৃষা বলে, ভগবান সাক্ষী প্রতীমদা, আমি তোমার বন্ধুকে ভালোবাসতামসেই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলনা। কখনো ওকে ছাড়া কাউকে কামনা করিনি। দীপক চলে যাবার পর আমাদের উপর কি বয়ে গেছে তা তুমি জানো। প্রথম প্রথম মনে হত, ও কি দেখছেনা আমাদের কষ্টগুলো? রাস্তায় চলতে চলতে মনে হত এই বুঝি হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে থেকে উদয় হয়ে হাতটা ধরবে সে। রাতে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতাম একা একা। মনে হত অন্ধকারের ভিতর থেকে কখন এসে পাশে দাঁড়াবে ও। মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, মুছিয়ে দেবে আমার চোখের জল। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। না ঘুমানো চোখে GS ছোট্ট দিয়াকে জড়িয়ে ধরতাম। কেউ এসে আমার চোখের জল মুছাতো না। একটু থামে তৃষা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আবার বলে, যে যায় সে আর ফেরেনা প্রতীমদা, সে আর কক্ষনো ফেরেনা। বলতে বলতে চোখের কোণা ভিজে আসে তৃষার। আবার থামে, আবার বলে, দিন কেটে যায়, বছর ঘুরে আসে, আস্তে আস্তে মনটা বুঝতে পারে যে, আর সে কোনোদিনই ফিরবেনা। কিন্তু যারা পড়ে রইল তাদের সমস্ত জাগতিক স্বত্ত্বা গুলো আবার ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মনে হয়, আমি কেন এইগুলো পাবোনা। কেউ পুরনো স্মৃতিগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন ভাবে বাঁচে। আর কেউ কেউ ইচ্ছে থাকলেও তা করতে পারেনা, GSতাদের পারিপার্শিকতা সেইটুকুও তাদের অনুমোদন করেনা। আমারো তো মন আছে, শরীর আছে, বল? সেও তো চায় তাকে কেঊ আস্ট্রে পৃষ্ট্রে জড়িয়ে ভালোবাসুক। কিন্তু বলা যায়না, মুখ ফুটে বলা যায়নাসেদিন প্রথম বুঝলাম যে মনের গভীরে তোমাকে কিরকম ভাবে জড়িয়ে ধরছি আমি, নিজের অজান্তেইধরা পড়ে গেলাম নিজের কাছে। তাইতো এত রাগ হল, তোমাকে অপমান করে বসলাম। তারপরে বিশ্বাস কর, নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি, সাত দিন নিজেকে কষ্ট দিয়েছি প্রতীমদা, কিন্তু আমি হেরে গেছি, আমি নিজের কাছে হেরে গেছি। বুঝেছি আমি দেবী নই প্রতীমদা, আমি মানুষ, আমি রক্তমাংসের একটা মানুষ। বলে হু হু করে কেঁদে ফেলে তৃষা। কাঁদতেই থাকে।
সময় যেন থমকে দাঁড়ায়। কেউ আর  কোনো কথা বলে না। অনেকক্ষণ বাদে সুপ্রতীম তার জায়গা ছেড়ে উঠে তৃষার সামনে দাঁড়ায়। আলতো করে নিজের হাতটা রাখে ওর মাথায়। GS সেই আলতো ছোঁওয়াতেই পরম যত্নে তৃষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সুপ্রতীম।
পাহাড় থেকে তীরবেগে নেমে আসা শীর্ণকায়া পৃথক দুটি স্রোতস্বিনী সমতলের সরলতায় পৌছে অকপট মিলনোন্মুখতায় একে অপরের সাথে নিশে যেতে চায়। সংস্কার ও সামাজিকতার বাঁধ ওই দুই ধারাকে বেঁধে রাখে তাদের নিজস্ব খাতে। হয়ত কোনও এক শ্রাবণ পূর্ণিমার তীব্র এক জলোচ্ছাস এই বাঁধকে একদিন গুড়িয়ে দিয়ে এই দুই ধারার মিলন ঘটাবে। হয়ত! কবে?  তা কেউ জানেনা। GS

GS।।সমাপ্ত।। GS

প্রতীক্ষা

শীতটা বোধ হয় এবার তাড়াতাড়িই পড়বে। সবে তো মাত্র ডিসেম্বর মাসের ক ’ টা দিন হয়েছে, পশ্চিমের সূর্যের তেজ যেন বিকেল হবার আগেই কেমন ম্লান ...