Search This Blog

Sunday, 13 August 2017

আপনঘর



ছাদের বিমটার পাস্ দিয়ে হালকা চিড় ধরেছে, নাইট ল্যাম্পের আলোতেও স্পষ্ট বুঝতে পারে সুজাতা জানলার পর্দাগুলোতেও কেমন হতশ্রী ছাপ ! ঘরের কোনাগুলোতেও হালকা ঝুলের আভাস দরজা জানলা গুলো বোধহয় খুব একটা খোলা হয়না, চারদিকে যা মশা ! এই বাড়িতে চিরকাল ই মশার উৎপাত বেশি এখন আর মশারি টাঙিয়ে শোওয়ার অভ্যাস চলে গেছে আজও যখন অগত্যা এই বাড়িতে থাকতেই হচ্ছে তখন মশারি আর টাঙায়নি সুজাতা, একটা মশা তাড়াবার মেশিন লাগিয়ে দিয়ে গেছে কেউ, তাতে ঘরে মশা নেই ঠিকই কিন্তু কেমন একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন বদ্ধ ঘরে থাকার অভ্যাস চলে গেছে একদম, ঘুমটা কি সেই কারণেই আসছেনা? বুঝতে পারেনা সুজাতা
শেষ কবে রাত কাটিয়েছে এই বাড়িতে? ভাবার চেষ্টা করে সুজাতা মনে পড়ে যায়, প্রায় চার বছর হলো চার বছর! চার বছর হলো মা নেই! পাশ ফিরে শুতেই আধো অন্ধকারে দেখতে পায় মা'কে ফটোফ্রেম এর মধ্যে থেকে মা হাসছে একটা প্লাস্টিকের মালা ঝুলানো ছবিতে চোখের কোন দিয়ে জলের স্রোত নেমে বালিশ ভিজে যায় এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলে মা আমাদের ছেড়ে?
বিয়ের পর এইবাড়িতে এলে এই ঘরেই মা আর মেয়ে শুতো রাতে খাওয়া দাওয়ার পাট মিটলে মায়ে ঝিয়ে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা হতো সংসারের টুকিটাকি গল্প, জামাই এর অফিসের চাপ, এই বাড়িতে টুকটুকির দুস্টুমি, টুকটুকিকে সামলাতে রিঙ্কির নাজেহাল অবস্থা, তাই নিয়ে মায়ের অনুযোগ.., দাদার আর রিঙ্কির ঝগড়া, বাবার বাজার করার বহর, মা কে ব্যতিব্যস্ত করা ফরমায়েশের চক্কর কি থাকতোনা সেই গল্পের সূচিপত্রে ! বিয়ের পরপর আর একটা প্রশ্ন, কিংবা জিজ্ঞাসা থাকতোই, তা হলো ঠারেঠোরে বোঝার চেষ্টা, শ্বাশুড়ি কি করেন, ননদের ব্যবহার কেমন, জামাই ঠিকঠাক খেয়াল রাখে কিনা, মায় জামাই ঠিকমতন আদর করেতো? এ যেন বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মায়ের চিরকালীন জিজ্ঞাসা ! যেন সমস্ত তথ্য একত্র করে বুঝে নিতে চাওয়া যে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে তার জায়গা পাকা করে নিতে পারলোতো?
বিয়ের ঠিক পরপর খড়দহ আর সোদপুর এর মাঝে কোনো এক জায়গায় বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন ছিল সুজাতাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ে ছিল বলেই সুজাতা আর তন্ময়কে একসাথেই যেতে হয়েছিল বিয়ের কাজ শেষ করে সুজাতা দেখলো যে বাড়ি ফিরে যাওয়া অসম্ভব, এত রাত হয়ে গেছে, আবার শখ করে বিয়েতে পাওয়া নেকলেস টাও পড়ে এসেছে, তন্ময় ই বললো, এতো রাতে বাড়ি না ফিরে চলো তোমাদের বাড়িতে চলে যাই , বাড়ি তে মা কে বলে এসেছি যে আজ রাতে নাও ফিরতে পারি, কাল সকালে আমি এখান থেকে অফিসে চলে যাবো, তুমি পরে বাড়ি ফিরো নিজে সেটাই চাইছিলো, কিন্তু নিজে মুখে তন্ময়কে সেটা বলতে বাঁধছিলো , তন্ময় যখন নিজে থেকেই প্রস্তাবটা দিলো, যেন নেচে উঠলো সুজাতা এইবাড়িটা গলির মধ্যে, রিকশা ঢোকেনা ভালোমতো মেইন রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে তন্ময় ভাড়া মেটাচ্ছিলো, সুজাতা দৌড়ে এসে বাড়ির গেট টায় আওয়াজ করলো, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা, আস্তেই ডাকলো, "মা, মা?" ১০ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলেছিলো মা, গেট এ মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যতনা আনন্দ তার চেয়ে হাজার গুন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার ছবি মায়ের মুখে দেখেছিলো সুজাতা বুঝতে পেরেছিলো তন্ময়, রিকশা ভাড়া মিটিয়ে তখন ও প্রায় এসে গেছে গেট এর কাছে দূর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলো মা কে," মা, আমিও আছি এখানে " তন্ময়কে দেখে মায়ের মুখের সেই আতঙ্ক এক নিমেষে দূর হয়ে যে নিশ্চিন্তির প্রলেপে ঢেকে গেলো তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওর মা'রা কি চিরকালই এমন উৎকণ্ঠায় ভোগেন মেয়ে কে নিয়ে? কে জানে! সুজাতার তো মেয়ে নেই, ও হয়তো ওর মায়ের এই মনের কথা কোনোদিন বুঝতেও পারবেনা তবে এতদিন বাদে এই বাড়িতে থেকে একটার পর একটা স্মৃতি ভেসে আসছে
এইঘরেই তো শুতো মা আর মেয়েতে মিলে খুব ফুলের শখ ছিল সুজাতার নিজের হাতে ছাদে কতনা ফুলের চাষ করতো, বাইরে গলিটা দিয়ে কোনো মানুষ গেলেই তাকাতো উপরের দিকে, ঘাড় উঁচিয়ে দেখতো মাথা উঁচু করে থাকা রংবেরঙের পেল্লাই সাইজের ডালিয়া, থোকা থোকা চন্দ্রমল্লিকার শোভা অথবা অনেক কষ্টে ফোটানো গোলাপের বাহার সুজাতা আর রিঙ্কি এক ক্লাসে পড়তো, সেই বন্ধুত্ব যেন কোথায় একটা অন্যরকম হয়ে গেলো যেদিন সম্পর্ক টা ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে বৌদি তে রূপান্তরিত হয়ে গেলো সুজাতা কি মেনে নিয়েছিল এই সম্পর্ক ? কে জানে? রিঙ্কির প্রেমে পরে তাদেরই বন্ধু অর্ণব কেমন পাগলের মতন হয়ে গেছিলো তাতো জানে সুজাতা তাই দাদা যেদিন এই সম্পর্কের কথা জানালো তার আদরের বোনকে, সে যেন সব বুঝেও বুঝে উঠতে পারছিলোনা বাঁধা দেয়নি, কিন্তু কিছু একটা গলায় কাঁটা বেঁধার মতন অনুভূতিও হয়েছিল ওর তা ও জানে বিয়ের পর আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক ও হয়ে উঠেছিল হয়তো পরস্পরকে আগে থেকে চেনার কারণেই সম্পর্কটা ঠিক ননদ বৌদির ছিলোনা, হয়তো বন্ধু হবার সুবাদেই ওর আচরণ ও সবক্ষেত্রে ঠিকঠাক হতোনা, নিজের বিয়েও হয়নি, নিয়মিত পাত্রপক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসে কোথাও একটা হতাশা, ঈর্ষা কাজ করতো, আজ বোঝে সুজাতা বোঝে যে অবিবাহিত অবস্থায় থাকা একটা মেয়ের বিবাহিত মেয়েদের মানসিকতা, তাদের সমস্যা, তাদের চাহিদা কি হয়তো সবসময় বোঝা সম্ভবনা, সেও বোঝেনি, তা রিঙ্কি যতই তার বন্ধু হোক
একদিনের ঘটনা মনে পড়লো ভোরবেলা রিঙ্কি ঘুম থেকে ডেকে তুললো সুজাতাকে ঘুম থেকে কেউ ডেকে তুল্লে এমনিতেই মাথা গরম হয় সুজাতার, আর সেদিন যা রিঙ্কি করেছিল তাতে মাথায় আগুন ধরে গেছিলো ঘুম থেকে সুজাতাকে বিছানায় উঠিয়েই ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিলো একটা সদ্য ডালভাঙ্গা শিশিরভেজা গোলাপ এর কুঁড়ি সেই গোলাপের কুঁড়ি হাতে নিয়ে ঘুমভাঙা চোখে গর্জে উঠেছিল সুজাতা, "তুই আমার গোলাপ ভেঙেছিস? এত্ত কষ্টে গাছে সবে কুঁড়িগুলো ফোটাতে পেরেছি.....!"
রাগ এর আঁচে ও শুনতেই পায়নি রিঙ্কি বলেছে "হ্যাপি বার্থডে সুজা..." আজও মনে মনে লজ্জা পায় সুজাতা সেদিনের সেই কথা মনে পড়লে
আসবেস্টস দেওয়া ছাদ এর চিলেকোঠার ঘরে ছিল দাদার আস্তানা বন্ধুবান্ধব কেউ এলে সামনে যাবার অনুমতি ছিলোনা, এমনি রক্ষনশীল ছিলেন বাবা সেই বাবাকে দেখলে আজ কেমন অবাক লাগে মা চলে যাবার পর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন, এমনকি যে বাজার নিয়ে মায়ের সাথে রোজ ঝগড়া, সেই বাজারেও আর যায় না বাবা, সবকিছু দাদাকে করতে হয় আর সেই ফুলটুসির মতন রিঙ্কি, কলেজের হার্টথ্রব, সে এখন এতটাই পৃথুলা হয়েছে যে ওদের বন্ধুরা অবধি ওকে দেখে চিনতে পারেনা, এই সেই রিঙ্কি! বছরের অর্ধেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় হাঁটু আর কোমরের ব্যথায় ইদানিং নাকি থাইরয়েডের সমস্যাও ধরা পড়েছে সুজাতাও কি ভালো আছে? পিরিয়ডের সমস্যাটা একটু একটু করে বাড়ছে রোজ, ডক্টর মুখার্জি সামনের মাসে লোয়ার অবডোমেন এর ইউএসজি করে নিয়ে যেতে বলেছেন এদিকে তন্ময়ের প্রমোশন হওয়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত সময় পায়না, বান্টিটার মাধ্যমিক সামনের বছর, সংসার সামলাতে ওরওতো নাজেহাল অবস্থা মা চলে যাবার পর এই যে চার বছর কেটে গেলো কতদিন ও আসতে পেরেছে এই বাড়িতে? অথচ সোদপুর থেকে সন্তোষপুর কতটা দূরত্ব! তাও পারেনি পারেনি কি? নাকি ইচ্ছেও করেনি মা চলে গেলে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থাকেনা? কে জানে? যতদিন এসেছে দেখেছে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়া এক অশীতিপর বৃদ্ধকে,নিজের ঘরে একলা টিভি চালিয়ে হয়তো বসে আছেন, বহুদিনের কাজের মাসি নমিতাদি চা এর কাপ এনে সামনে রাখলেন, রিঙ্কি তার শরীরের কারণে তার দোতলার ঘর থেকে নীচে নামতে পারেনা, বিয়ের অনেক পরে বানানো দোতলার ঘরে সে হয়তো তখন টুবলুর পিছনে লেগে রয়েছে, টুবলুকে তার হোমওয়ার্ক এর জন্য তাগাদা দিচ্ছে, টুবলুও ছাড়বেনা, সে তার পিসিমনির কাছে বায়না জুড়েছে যে পার্ক এ ঘুরতে যাবে! সেই পুতুলের মতন টুকটুকি এখন লেডি! কি মিস্টি দেখতে হয়েছে ! সেওতো এই বছর হায়দ্রাবাদ চলে গেছে কিসব পড়তে যেন! বাড়িটাও কেমন খা খা করে!
ছাদের সেই ঘরটা নেই এখন ওটা টুবুলের পড়ার ঘরে পরিণত হয়েছে একদিন নমিতাদি না থাকায় দাদাদের ঘরে চা দিয়ে পাঠিয়েছিল মা চুপিচুপি, যেন বাবা না দেখতে পারে দরজায় ঢুকতে গিয়েই দুজনের কথোপকথনে পা থমকে দাঁড়িয়েছিল সুজাতা ও শুনলো অমিতদা দাদাকে বলছে, "শুভ, আমি একটা অপরাধবোধে ভুগছি, জানি এই চিন্তা আশা আমার উচিত না, তবুও তোকে না বলে পারছিনা "
--"কি হয়েছে বলে ফেল "
--" আমি সুজাতার প্রতি কেমন দুর্বলতা ফিল করছি "
দাদা অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বললো, "সুজাতা? আর ও?"
--"না, না, সুজাতা কিছু জানেনা, এটা আমার একতরফা ফিলিং , তোকে না বললে অপরাধী লাগছিলো নিজেকে, তাই বললাম "
বাকিটুকু আর শোনেনি সুজাতা নিঃশব্দে নীচে চলে এসে মা কে বলেছিলো, "ওদের দরজা বন্ধ মা, আমি ডাকতে পারিনি, তুমি যাও"
কেউ ওকে ভালোবাসতে পারে, কারো চোখে সেও ভালোবাসার কেউ হতে পারে বুঝেছিলো সেইদিন প্রথম ভালো লেগেছিলো? আনন্দে ভেসে গেছিলো? বাবার কি প্রতিক্রিয়া হবে তা ভেবে কুঁকড়ে গেছিলো? আজ আর তা মনে করতে পারেনা সুজাতা তবে অমিতদা এইবাড়িতে আসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো সেদিনের পর
অনেকদিন পর নিজের শহরে ঘুরলো সুজাতা, দাদার সাথে বাইকে বর্ষা হলেই এই নাটাগড় , এইচ বি এর রাস্তায় জল থৈ থৈ করতো, সুলেখা র মোর টা চিনতেই পারেনা এখন সুজাতা গোশালার মাঠকে পাশে ফেলেই তো স্কুলে যেতে হতো ওকে কিরকম সব পাল্টে গেছে ! এইমাঠেই শীত পড়লেই সার্কাসের দল তাবু ফেলতো মেলা, কত খুশি ! আজ ও চোখ বুজলে শ্রীনিকেতনের একতলা দোকানটা যেন চোখের সামনে ভাসে! আজ তার বিপরীতে পেল্লাই মাল্টিসোরেড শপিং কমপ্লেক্স, সুজাতা যদিও সোদপুরে এসে কেনাকাটা করেনা, ওরতো পা বাড়ালেই সাউথ সিটি, রোজকার নিত্যিদিনের টুকটাক কেনাকাটার জন্য গড়িয়াহাট, আর বাইপাসের ধরে বিগ বাজার আছেই ও কোন দুঃখে শ্রীনিকেতন আসবে কেনাকাটা করতে! তবুও পুজোর সময়ে মা বাবার হাত ধরে পুজোর জামা কিনতে যাবার সময়কার ছবিটা যেন স্মৃতিতে কেউ আটকে রেখে যায় এক্সিবিশন এ টাঙানো ছবির মতন যে ছবিতে সময়ের ব্যবধানে ধুলো পড়েনা, হয়তো একটু ম্লান হয়ে যায়, কিন্তু সেই ম্লান ছবিটাই যখন চোখের সামনে ফুটে ওঠে চোখটা কখন যেন ঝাপসা হয়ে ওঠে ক্ষনিকের জন্য
রিঙ্কি আর দাদার বিবাহবার্ষিকী সামনে কত তম এটা? ২২তম হবে বিকেলে দাদা ফিরতেই বললো. "চল দাদা একটু ঘুরে আসি, কতদিন নিজের শহরে ঘুরিনা, সবকিছু কেমন পাল্টে গেছে" রিঙ্কিকে ডেকে বললো, "যাবি রিঙ্কি? চল একটু বেরিয়ে আসি "
--"আমি পারবো না রে, একটু হাঁটলেই আমি হাঁফিয়ে যাই, তুই বরং তোর দাদাকে নিয়ে ঘুরে যায় "
মনে কোনো প্যাঁচ নিয়ে বলেনি রিঙ্কি, ও সত্যিই পারেনা এখন ওই চেহারা টাকে সামলে রাস্তায় বেরোতে, খুব কষ্ট হয় ওকে দেখলে, টুবলু হবার পর শরীরের সব ক্ষমতা যেন আরো হারিয়ে ফেলেছে, এখন বসে থাকলেও কেমন হাঁফায় মা চলে যাবার পর একটু হলেও তো সংসারের চাপ বেড়েছে, নমিতাদি আর কত করবে, তারওতো বয়স হচ্ছে ! মাঝে মাঝে সেই পুরোনো রিঙ্কির সাথে আজকের রিঙ্কিকে পাশাপাশি রেখে কল্পনা করে সুজাতা, খুব অবাক হয়, ভাবে আচ্ছা অর্ণব যদি আজকের রিঙ্কিকে দেখতো, পাগল হতে পারতো?
দাদাটাও কিরকম হয়ে গেছে! দাদা বরাবর হ্যান্ডসাম, লম্বা পুরুষালি চেহারা, ছোটবেলায় কত বান্ধবীর মুখে শুনেছে, সুজা'র দাদাকে একদম চিরঞ্জীত এর মতন দেখতে সাধে কি রিঙ্কি দাদাকে পছন্দ করেছিল? শুধুতো হ্যান্ডসাম, নয়, শুভব্রত রায় এর এই তল্লাটে নাম ছিল ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হিসাবে সেই দাদাই কত পাল্টে গেছে, মাথার চুলগুলোতে সাদা ছোপ, চোখে চশমা, লম্বা চেহারাটা কেমন ঝুঁকে গেছে যেন সবকিছু পাল্টে গেছে, নিজের দিকেও তাকিয়ে দেখে আজকাল এই অনুভূতি হয়, বুড়ি হয়ে যাচ্ছি?! কষ্ট হয় কেমন যেন, কিন্তু মুখে প্রকাশ করা যায়না!
--"দাদা, ঘোলার ওদিকে একটা আশ্রম ছিল মনে আছে? একজন সাধুবাবা ছিলেন, খুব ভক্তি আসতো ওঁকে দেখে, আছে এখনো ওই আশ্রমটা? সাধুবাবার বেঁচে থাকার কথা নয় যদিও"
--"জানি নারে, যাবি কি? চল তাহলে দেখে আসি"
--"না থাক, চল বিটি রোডের দিকে চল" কি ভেবে বলে উঠলো সুজাতা হয়তো ভাবলো ছোটবেলার সেই ভালোলাগার আশ্রমটাও যদি গিয়ে দেখে নেই, খুব কষ্ট পাবে, তার চেয়ে ভালো সত্যিটা না জানা
বিটি রোডের ধারের প্যান্টালুনস থেকে দাদাদের এনিভার্সারি গিফটস, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, টুবলুর জন্য একটা ভালো খেলনা গাড়ি, টুকটুকির জন্য একটা টপ কিনে বাড়ি ফিরলো দুই ভাইবোন
বিকেলে ঘুরে আসার পর বাবা সবাইকে ডাকলেন আলমারি খুলে একটা বাক্স নিয়ে আসলেন, বাক্সটাকে খাটের উপরে রেখে বললেন, "যে জন্য তোকে আজকে এতো জোর দিয়ে থাকতে বললাম বুবু, বাবিন আছে, বৌমা ও আছে, আমি চাই আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোদের মায়ের গয়নাগাটি কাপড়চোপড় যা আছে তা নিজে হাতে ভাগ করে দিতে যাতে আমার অবর্তমানে এগুলো নিয়ে কোনো অশান্তি নাহয় তোদের দুই ভাইবোনে "
রিঙ্কি বলে উঠলো, "বাবা, আপনি না ভাগ করলেও আমাদের মধ্যে এগুলো নিয়ে অশান্তি, ঝামেলা হতোনা "
--" জানি বৌমা, আমার ছেলে মেয়েদের সে শিক্ষা আমি দেইনি, আর তোমার উপরেও আমার সেই ভরসা আছে তবুও জানতো, অর্থ অনর্থের মূল? তাই এই প্রয়োজনীয় কাজটা আমি করে যেতে চাই তোমাদের মায়ের আলমারির চাবি দিয়ে দিচ্ছি, মায়ের যা আছে তোমরা দুই মেয়ে বৌতে ভাগ করে নাও "
কান্না আর কান্না! পার্থিব সম্পদ লাভ হচ্ছে, তাও চোখের জল বাঁধ মানেনা কেন ? কত পরিবারে তো শোনে যে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে মারামারি, কাটাকাটি, মামলা মোকদ্দমা, মায় খুনোখুনি পর্যন্ত! এখানেতো সেসব কিছু নেই, পারলে কে কাকে কোনটা দিয়ে দেবে তার কম্পিটিশন চলে, যেন অধিকার ছেড়ে দিয়ে বোঝাতে চায় ,"আমার নিজের যা আছে তা যথেষ্ট রে, আর বেশি কিছু চাইনা " ভাগাভাগির পর্বটা রোমাঞ্চহীন বলেই কি মা কে আরো বেশি মনে পড়ছে ? মায়ের এক একটা গয়না খোলা হচ্ছে আর সুজাতার সামনে এক একটা দিনের গল্প যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঁকি মেরে যাচ্ছে, হৃদয়ের মধ্যে কান্নার বাঁধ ভাঙছে অথচ কাঁদা যাচ্ছেনা, বাবার কথা ভেবে দাদাও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, সুজাতা জানে দাদাও হয়তো হেঁটে বেড়াচ্ছে ছেলেবেলা অথবা যৌবনবেলার স্মৃতির অলিগলিতে
বেশি গয়না মায়ের ছিলোনা, সেটা ভাগ হতেও সময় লাগলোনা, কাপড়গুলো ভাগ করার সময় সুজাতা বললো, "রিঙ্কি, তুই তো শাড়ি খুব একটা পরিসনা, আমায় শুধু মায়ের আটপৌরে শাড়িগুলো দে, ওগুলো আমি বাড়িতে পড়বো "
--"তা বললে হবে সুজা, ভালো শাড়িগুলোও নে", এই বলে নিজেই বেশ কয়েকটা শাড়ি সুজাতার জন্য আলাদা করলো কিছু শাড়ি নিয়ে বললো, "এগুলো বাবা নমিতাদি আর হাবুর মা কে দিয়ে দেই?"
যেন স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চলছে সব নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে এক একটা জিনিস হাতে আসছে সুজাতার আর মনে হচ্ছে যেন একএকটা করে ডালপালা কেটে একটা গাছকে শীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে এইবার গাছটাকে মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হবে বুকের কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আসতে থাকে সুজাতার
মোক্ষম কথাটা বললেন বাবা এরপরে
--" এই বাড়িতে তোমাদের দুই ভাইবোনের সমান অধিকার কিন্তু বুবু, তুই কোনোদিন এইবাড়িতে এসে থাকবি না, এই বাড়ি করার পিছনেও তোর দাদার অনেক কনট্রিবিউশন আছে তবুও তুই তন্ময়ের সাথে একবার কথা বল, ওর মতামত জানলে পর এই ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নেবো "
--" তুমি তো তোমার জামাইকে চেনো বাবা, এই বাড়ির বিষয়ে ওর কোনো বক্তব্য নেই, তার দরকার ও নেই, আমি বলছি এই বাড়ির ভাগ আমার চাইনা"
--"আমি সবকিছু আমার বুদ্ধিতে করছিনা বুবু, যা করছি তা তোর মায়ের ইচ্ছেতেই করছি " এইটুকু বলে পাশের ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা ব্যাঙ্কের চেক বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, "তুই ভাগ নিবিনা জানিরে, কিন্তু বাবা হিসাবে আমি কোনো পার্সিয়ালিটি করতে পারিনা এটা তুই রাখ, বাড়িটা আমি বাবিনের নামে দানপত্র করে দেব "
--"এটাও আমি তোমার জামাইয়ের সাথে কথা না বলে নিতে পারবোনা "
--"আমি তন্ময়ের সাথে কথা বলেছি আজকে বিকেলে এই বিষয়ে তোরা তো আমার সন্তান রে, আমি জানি আমার কাজকে তোরা সমর্থনই করবি "
--"সব হিসাব চুকিয়ে দিচ্ছ বাবা, এইবাড়ির সঙ্গে থেকে সুজাতা বসুর নামটা মুছে দিলে পুরোপুরিভাবে ?" মনে মনে এই কথা বললেও মুখ ফুটে বেরোলোনা তা, বাবা কষ্ট পাবে, দাদা কষ্ট পাবে!l
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ অনেকক্ষন একা এই খাটে শুয়ে থাকতে থাকতে কত কিছু মনে পরে সুজাতার এইবাড়িতে জন্ম, এই বাড়ির প্রতিটা আনাচেকানাচে কে চিনতো ও, আজ থেকে আর এই বাড়ির সাথে সুজাতার নাম জড়িয়ে থাকবেনা এই কষ্ট কি সব মেয়েরই হয় জীবনে? এই বাড়িতে আমি জন্মালাম, এইখানে বড় হলাম, এই বাড়ি এই মাটির সাথে মিশে থেকে আমি জীবনকে চিনলাম, আর একদিন হঠাৎ করে জানলাম এইখানে আমার আর নিজস্ব বলে কিচ্ছু নেই! বৌভাতের রাতে তন্ময়ের বলা একটা কথা মনে পড়লো সুজাতার
--"এখন থেকে এই বাড়ি তোমারও, তাই এর ভালোমন্দ, সম্মান বদনামের ভাগিদার ও তুমি" একটু থেমে তন্ময় আবার বললো, " আচ্ছা সুজাতা, এই যে বললাম, যে এই বাড়ি তোমারও, কিসের জোরে বললাম? জানো?"
এতকিছু বোঝেনা সুজাতা, শুধু বলেছিলো, "জানিনা আমি তোমার স্ত্রী বলে?"
হেসে উঠেছিল তন্ময়, "একদম ঠিক, কিন্তু জোরটা কিসের?" অনেকক্ষন থেমে বলেছিলো, " জোরটা আইনের যে মুহূর্তে তুমি মিসেস তন্ময় বসু হলে সেই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার যা আছে তার আইনি অংশীদার এই আইনি অধিকারটা হলো কাঠামো, এর উপরে ভালোবাসা , দায়, দায়িত্ব, কর্তব্য এগুলোর প্রলেপ দিয়ে সংসারের মূর্তি টা গড়তে হয় ভুলোনা এটা"
আজও ভোলেনি সুজাতা
সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হলো, আসলে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুম আসতেই দেরি হলো বিছানার পাশে রাখা মোবাইল এ দেখলো অনেকগুলো মিসড কল বান্টির , তন্ময়ের কি হলো এর মধ্যে! ৪ বার ফোন করার লোক তো তন্ময় নয় ! দুশ্চিন্তা নিয়েই ফোন করলো বান্টিকে
--"ও মা, কতবার ফোন করছি তুমি ধরছোই না, এদিকে জানো কি হয়েছে ? আজ সকালে রিনা মাসির ছেলে বাবাকে ফোন করে জানিয়েছে যে রিনামসির জ্বর, আসতে পারবেনা তুমি চিন্তা করোনা মা, মি এন্ড বাবা ম্যানেজড ইট ওয়েল. ঠাম্মিকে দুধ গরম করে দিয়েছি, উইথ কর্নফ্লেক্স বাবা আর আমি টোস্টারে টোস্ট বানিয়েছি, এখন বাবা চা করছে আর বলেছে যে অফিস যাবার আগে সুইগিতে লাঞ্চ অর্ডার করে দেবে তুমি একদম ভেবোনা আজ স্কুল যাবোনা, বাড়িতে ঠাম্মি একা থাকবে তো বিকেলে ম্যাথস এর টিউশন আছে কিন্তু তুমি কখন আসবে?"
--" ঠিক আছে ঠিক আছে, তোমরা বাপ্ ছেলে আমার রান্নাঘরের কি অবস্থা করবে তা আমার জানা আছে, দাও তোমার বাবাকে ফোন টা দাও"
--"দিচ্ছি দিচ্ছি, বাবা মায়ের ফোন"
--" এই শোনো, আমি একটু পরেই চলে আসছি, তোমার ওই সুইগি ফুইগিতে কিচ্ছু বলতে হবেনা, ঐসব খাবার মা খেতে পারবে? যা খুশি তাই করলেই হলো? আমি এসে যা করার করছি বুঝেছো? আর পারলে অফিস বেরোবার আগে লন্ড্রি থেকে জামাকাপড়গুলো এনে রেখো ঠিক আছে আমি রাখছি "
ফোনটা রেখেই চিৎকার করে বললো, "দাদা তোদের এখানেতো এখন ওলা উবের পাওয়া যায়, দেখনা একটা এভেইলেবেল কিনা আমি দশ মিনিটের মধ্যে বেরোবো এখন এই ব্যাগপত্র নিয়ে কিছুতেই ট্রেনে ওঠা যাবেনা "
রিঙ্কিও চিৎকার করে বললো, " সেকিরে, তোর জন্য ট্যাংরা মাছ আনলো তোর দাদা, এতো ভালোবাসিস তুই, আর তুই বলছিস চলে যাচ্ছিস?"
বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে কোনোক্রমে সুজাতা বোঝালো যে কেন ওর যাওয়াটা জরুরি
গলির মুখে দাঁড়ানো ওলার সুইফট ডিজায়ার এ ব্যাগপত্র তুলে দিলো শুভ বাড়ির গেট এ দাঁড়িয়ে বাবা, নমিতাদি। রিঙ্কি তার ভারী শরীর নিয়ে দোতলার বারান্দায়, টুবলুটা বোধহয় স্কুলে, ও শুধু নেই বাড়ির গেট থেকে বেরোলো সুজাতা সবাইকে আবার হাত নাড়লো
কাল যেসব কিছু ভেবে চোখের জল ফেলেছিলো রাতভর তার আর বিন্দুমাত্র কিছু ওর মনে নেই, ওর মন ছুটে গেছে নিজের বাড়ির দিকে, গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, "যাদবপুর সন্তোষপুর, যেদিক দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে সেইদিক দিয়ে চলো "


*****


সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment

প্রতীক্ষা

শীতটা বোধ হয় এবার তাড়াতাড়িই পড়বে। সবে তো মাত্র ডিসেম্বর মাসের ক ’ টা দিন হয়েছে, পশ্চিমের সূর্যের তেজ যেন বিকেল হবার আগেই কেমন ম্লান ...