(এক সত্যি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লেখা)
একটু আগেই ঘর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গেছে অভি, বলা ভালো পালিয়ে
গেছে। আমার ভীষণ ভয় করছে, ওর জন্য, কিন্তু আমার কথা কে শুনবে এখন! সবাই আমাকে আগলিয়ে
রেখেছে, মুখচোখে এমন ভাব যেন কি একটা ঝড় বোধহয় বয়ে গিয়েছে একটু আগে, আর চারদিকে ছড়িয়ে
রেখে গেছে ধ্বংসস্তুপের পাহাড়! আর সেই ধ্বংসস্তুপের মাঝে আমার মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন
কেমন যেন প্রাণহীন এক একটা প্রস্তরখন্ডের মত এলোমেলো, অবিন্যস্ত পড়ে আছে। মা’র মুখ দিয়ে মৃদু স্বরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ আসছে। আমার খুব
খারাপ লাগছে ওদের জন্য। কিন্তু, আমি কিছু বলতেও পারছি না, বলার মত তেমন অবস্থাও নেই যদিও এখন আমার! বারান্দায়
একমাত্র মুনিয়া শুধুমাত্র একনাগাড়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে যাচ্ছে। এই অসহ্য নীরবতার মাঝে
মুনিয়ার আওয়াজ আর মা’র কান্নার আওয়াজ
পরিবেশকে কেমন যেন শোকাচ্ছান্ন করে তুলেছে।
রূপ
ছোটবেলা থেকে সবাই আমার চোখের খুব প্রশংসা করত। বন্ধুরা
বলত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নাকি কারও মনে কোন পাপবোধ আসবেনা, এমনই স্নিগ্ধ ছিল
নাকি আমার টানাটানা চোখদুটি। সবার কাছে শুনি যে বাড়িতে মেয়ে হলে নাকি কারো কারো
মুখ কালো হয়। মা’র কাছে শুনেছি, আমি
হবার পর এই বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। অনেক ভাইয়ের পরে আমি ছিলাম প্রথম
বোন। স্বভাবতই আমার আদরের কোনও তুলনা ছিলনা। বাবা সখ করে নাম রেখেছিলেন অরুন্ধতী। পরে বন্ধুরা বলত, “আচ্ছা কাকাবাবু কি’করে জানলেন বলত যে তুই সত্যি সত্যি অরুন্ধতী
দেবীর মতন দেখতে হবি?” সত্যি কি না
জানিনা তবে এই কথা আমি বন্ধুরা ছাড়াও অন্য অনেককে বলতে শুনেছি। বাবা বলতো, “তুই আমার আকাশে ভোরের তারা, তাই
অরুন্ধতী’’। অভিকে জিজ্ঞাসা
করলে বলতো, “সে আমি জানিনা, আমি
শুধু জানি যে এই মুখ দেখতে আমি একশো মাইল হেঁটে আসতে পারি।’’ লজ্জা পেতাম, আবার ভীষণ ভালোও
লাগতো। অভির মুখে এই কথা শুনতে শুনতে মনে হোত যে আমি পাখী হয়ে উড়ে চলেছি নীল
আকাশের মাঝে সাদা পেঁজা তুলোর মত ভেসে চলা মেঘের মধ্যে দিয়ে! মুখে বলতাম, “ধ্যাত, তুমি না!’’ অভিকে কবে থেকে তুই থেকে তুমি বলা
শুরু করেছি আজও মনে করতে পারি আমি।
সেই সময়টা যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এত রমরমা ছিলনা,
তবু আমি ছোটবেলা থেকেই শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই পড়েছি। অভি ভরতি হল
কয়েক বছর পর, যখন ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে কলকাতা এলেন দিল্লী থেকে। অভির বাবা আমার
বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবার সুপারিশেই অভিকে আমাদের স্কুলে ভরতি করালেন ওর বাবা।
অভি আমার বন্ধু হয়ে উঠল কি করে তা আশ্চর্য ঘটনা।
স্বভাবগত ভাবে আমার ঠিক বিপরীত ছিল ও। আমি ছোট থেকেই ভীষণ চঞ্চল, ডানপিটে। ক্লাসে
বরাবর প্লেস পেতাম বলে টীচাররা ভালবাসতেন খুব, তাই হয়ত কোনোদিন “গার্জেন কল’’ হয়নি, কিন্তু তাই বলে আমার দুষ্টুমির খবর যে ওঁরা
রাখতেন না তাও নয়। প্রশ্রয় দিতেন হয়ত, জানিনা। অভি ছিল চুপচাপ, একটু ইন্ট্রোভার্ট,
সবসময় মুখ গুজে হয় বই পড়ছে অথবা জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে এই স্কুলে ভরতি
হবার জন্য, নাকি ছোট থেকে মায়ের স্নেহ না পাবার জন্য বুঝতে পারতাম না তখন, ও এমনই
ছিল। পরে বুঝেছিলাম যে, মা না থাকার যন্ত্রণাকে ও ভুলতে পারতনা। আমার মা কে যে ও
কি ভালবাসত তা আমি বোঝাতে পারবনা। যখন অভিরা দিল্লী থেকে কলকাতায় এল, বাবার কাছ
থেকে সব শুনে মা বাবাকে বলল, “অরুণ ঠাকুরপোকে বলে
তুমি ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসবে আমার কাছে । আহা রে, এইটুকু ছেলে, এই ছোট বয়সে মা
হারা হবার কষ্ট কেন দিলে ওকে ভগবান!’’ মা’কে মায়ের মত ভাবা
সেই শুরু। মা ও তার অপত্য স্নেহ উজার করে দিয়েছিল অভিকে। এই বাড়িরই ছেলে হয়ে
উঠেছিল অভি। এমনকি আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের দাদাদেরও ভীষণ প্রিয়
পাত্র ছিল ও।
এইপ্রথম আমাকে কেউ রিয়েল চ্যালেঞ্জ এর সামনে ফেললো।
ক্লাস ফোর এর অ্যানুয়াল রেজাল্টে অভি ফার্স্ট হল, আমি হলাম সেকেন্ড। সবাই ভাবতে
শুরু করল, এইবার বোধহয় অরুন্ধতী আর অভিলাষের মধ্যে রেষারেষি শুরু হবে। হয়নি। আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। তবুও
কিভাবে যেন আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত কেমিষ্ট্রি তৈরী হয়ে গেল। অভির সব কথা
শুধুমাত্র আমার সাথে, রাগ হলেও আমি, অভিমান হলেও আমি, কিছু খেতে ইচ্ছে হলেও আমি,
কোথাও যেতে হলেও আমি। আস্তে আস্তে আমি যেন ওর সব না বলা কথাগুলো ওর মুখ দেখেই বুঝে ফেলতে পারতাম।
হয়ত দুই বাড়ির সম্পর্ক টা একটা ফ্যাক্টর ছিল, হয়ত মা’র অভির প্রতি
অত্যধিক অপত্যস্নেহটা একটা কারণ ছিল, তবুও কিন্তু কোনদিনও অন্য কোন অনুভূতি মাথায়
আসেনি। এমনকি ক্লাসের সবাই জানত যে অভিলাষ ও অরুন্ধতী সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
কোনদিন আমি অভিকে আমার কম্পিটিটর ভাবিনি, বরং ও আমাকে
ছাপিয়ে গেলে আমার কেন জানিনা ভালো লাগত। কেন ভালো লাগত তা বুঝলাম যখন প্রথম আমাকে
ছেড়ে চলে গেল খড়গপুরে, এইচ এসের পর। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমি চান্স
পেলাম সি এম সি এইচ এ। আমার বাড়িতে আমার দাদু ডাক্তার, আমার কাকু ডাক্তার, আমার রাঙাদা
ডাক্তার। ডাক্তারি আমাদের বংশে। আমার ডাক্তার না হলে চলে? এটা ঠিক বলে বোঝাতে
পারবনা, তবে পরিবারে অনেক ডাক্তার থাকলে কেন জানিনা পরোক্ষে ডাক্তারির দিকে একটা
ঝোঁক এসেই যায়।
সেই প্রথম অভিকে অনেকদিন না দেখে থাকা। ডাক্তারী পড়ার
প্রথম বছর। অথচ অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি কিছুতেই মন বসাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে কি যেন
নেই আমার। মনটা মাঝে মাঝে হু হু করে উঠছে! তখন তো মোবাইলের সুবিধা চালু হয়নি! যদিও
অভি মাসে একদিন দুইদিন বাড়িতে ফোন করে মা’র সাথে কথা বলত, কিন্তু কখনো আমাকে চায়নি। খুবই
অস্বাভাবিক ঘটনা যদিও, তবুও চায়নি। মা ই একদিন বলল, “তুলির সাথে কথা বলবি অভি, ও পাশেই আছে।’’ আমি বলেছিলাম, “আমার সাথে কি কথা? আমার সাথে কথা
বলতে চেয়েছে যে আমাকে ফোন দিচ্ছ?” মা হেসে বলেছিল, “এই দেখ, মেয়ের রাগ হয়েছে, নে কথা বল
তোরা।’’ বলেই ফোনটা আমার
হাতে দিয়ে মা নিজের কাজে চলে গেছিল। ফোন হাতে নিয়ে আমি কোন কথা বলছিলাম না, সত্যিই
আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।
একটু পরে বললাম, “কিছু কথা বলবি না ফোন রাখব?’’ একটু থেমে অভি বলল, “তোকে ছাড়া সারা জীবন কাটাবো কি করে তুলি?’’
-“ হ্যাঁ, তার জন্যই
তো একবারও খোঁজ করিস না!’’
-“দেখছিলাম রে, তোকে
ভুলে থাকতে পারি কিনা”
-“পেরেছিস তো।”
-“পারছিনা রে, মনে
হচ্ছে আমার হার্ট টাই নেই আমার বুকের ভিতর। এতদিন তুই সাথে সাথে ছিলিস, কখনো
বুঝিনি যে আমি এতটা অসম্পূর্ণ’’
-“আমারো পড়াতে মন
বসছে না রে অভি, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়’’, আগেই বলেছিলাম যে অদ্ভূত এক কেমিষ্ট্রি ছিল আমাদের মধ্যে, রাগ করে
থাকা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু সেইদিন এই জীবনে প্রথম অভিকে কেমন অসহায়ের মতন লাগল। ওর গলার স্বর এই
প্রথম কেমন যেন কেঁপে উঠল কথা বলতে বলতে।
খড়্গপুর থেকে পূজার ছুটিতে এসেছিল অভি। সেদিন ছিল কোজাগরী লক্ষীপূজার রাত। আমাদের বাড়িতে বিরাট করে পূজা হত। ভোগ হত। শাড়ি
পড়েছিলাম আমি একটা, মায়ের জামদানী। ঠাকুরমশাই আশীর্ব্বাদ করে বললেন, “রাজরাণী হও মা।’’ প্রসাদ দিতে গিয়ে দেখি অভি নেই।
কোথায় গেল ছেলেটা! একটু আগেই তো রাঙাদাদার সাথে কথা বলছিল! প্রসাদের থালা হাতে উঠে
এলাম ছাদে। আমি জানতাম একা এইখানে ছাড়া কোত্থাও যাবেনা ও। ছাদে পা দিয়েই মনটা কেমন
যেন হয়ে গেল। চারপাশে কেমন এক অদ্ভূত শান্ত শীতলতা। সারা ছাদ ভেসে যাচ্ছে কোজাগরী
পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মায়াবী মধুর আলোছায়ায়। পৃথিবীকে আগে কখনও এত মোহময়ী
লাগেনিতো! ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে অভি। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলাম আমি,
আমার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, এই অপরূপ পরিবেশে আমার চঞ্চলতাও কেমন যেন স্তিমিত হয়ে
গেল। আস্তে ডাকলাম, “অভি’’।
-“আয়।’’
একেইকি বলে মোহাবিষ্ট হয়ে যাওয়া! না কি সারা শরীরের
সমস্ত স্বত্বা কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে এমনভাবেই আচ্ছন্ন হয়ে যায়! আমি আস্তে আস্তে
ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রসাদের থালাটা আমার হাত থেকে নিয়ে ছাদের আলশের উপর রেখে পরম
মমতায় আমার হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিল অভি। যেন বুকের গভীরতম স্থান থেকে কিছু বলছে এমনভাবে বলল, “একটা জিনিস চাইবো তুলি?’’
আমি কি বলব? আমার সারা শরীরে হাজার আলোর ঝরণা সন্তুরের
সুরের মত রোশনাই জ্বেলে শিরা উপশিরা দিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে চলেছে, আমি
স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে আছি। যেন আমি এই জগতের কেউ নেই, আমার মন এক অপার আনন্দের ভালো
লাগায় ভেসে যাচ্ছে, অথচ আমি সম্মোহিতের মত বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি!
অভি এক অদ্ভূত কান্ড করল। আমার হাতদুটোকে নিজের হাতে
নিয়েই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, মুখ তুলে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “আমি অনেক ভেবে দেখছি তুলি, তোকে ছাড়া
আমি কেউনা রে, তুই ছাড়া আমি শূণ্য। আমাকে সম্পূর্ণ করে নিবি তুলি? আমার বউ হবি?’’ কি বলব আমি, আমার অবচেতন মনের না
বলা কথাগুলো অভি বলে দিল যে! অদ্ভুত ভাললাগা শরীরে শিহরণ তুলে দিচ্ছে, বাইরের
জ্যোৎস্নার আলো আমার শরীর মনকে ভিতর থেকে ধুইয়ে দিচ্ছে, তবু আমার মুখ দিয়ে কোন
শব্দ আমি করতে পারছি না। শুধু বললাম, “অভি’’! দুই হাত দিয়ে
আমার কোমর জড়িয়ে মুখ গুঁজে দিল অভি। আমি কেঁপে উঠলাম। নিজেকে সমর্পনের সাক্ষী হয়ে
থাকল কোজাগরীর ওই চাঁদ। এক সময় ওর মুখ ধরে বললাম, “ওঠো।’’ আমার হাত
ভিজে গেল। অভির চোখের জলে। এত ভালবাসে আমাকে? আমাকে নিজের করে পাবার আনন্দে ওর
চোখে জল আসে! কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি! নিজেকে সত্যি রাজরাণী মনে হল। পাগলের মত
আঁকড়ে ধরলাম অভিকে। অনন্তকাল যেন কেটে গেল। আমার মুখটা নিজের দুই হাতে তুলে নিয়ে
আমার কপালের ঠিক মাঝখানে ঠোঁট রাখল অভি। কেঁপে উঠলাম আমি। বুঝলাম, দুটি হৃদয় যখন
একই সুরে অনুরণিত হয় তখন এই পৃথিবীতেই স্বর্গ নেমে আসে। মনের মানুষ কে নিজের করে
পাবার, তার মনকে সম্পূর্ণ করে পাবার যে উপলব্ধি তা স্বর্গীয় এক ফুলের সুবাস ছড়ায়,
মনকে অনন্য পবিত্রতায় ভরিয়ে তোলে।
*******
কুরূপ
বিদিশা আর আমি ফিরছিলাম। আর কয়দিন পরেই আমার বিয়ে। অভি
ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে এম টেক করছে। বি টেক করার পর আমেরিকা গেছিল চাকরী নিয়ে। চাকরী করতে করতেই ওর মনে হয়েছে যে
এম টেক টাও করে নেওয়া জরুরী। চাকরী করতে করতে ওদের দেশে নাকি এমন করা যায়। আমি
অবশ্য আমার ডাক্তারী ছাড়া কিছু বুঝিনা,
মাথা ঘামাবার ও প্রয়োজন নেই। আমার এম ডি পরীক্ষার ফাইনাল সবে শেষ হয়েছে। এখন
কয়েকদিন ছুটি। যদিও হাসপাতালে যেতেই হয়, তবুও সেদিন যাইনি। পুরনো বন্ধুরা সব এক
জায়গায় বসে খুব আড্ডা দেব, এই ছিল প্ল্যান। জয়তী, একটা নামকরা মেয়েদের কলেজের
লেকচারার, বিয়ে টিয়ে করবে না (কারণ টা আমি জানি কিন্তু এখানে বলার দরকার নেই), দমদম
এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেটে ফ্ল্যাট কিনেছে, সেখানেই আমাদের গেট টুগেদার। বিদিশা
আমার স্কুল লাইফের বন্ধু। আমাদের ঠিক পাশের পাড়াতেই ওদের বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্ত
বাড়ির মেয়ে হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। পড়াশোনায় তেমন কিছু না হলেও যে কারণে
বিদিশা জনপ্রিয় ছিল তা হল ওর অভিনয়। অসামান্য অভিনয় করতো ও। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি
লম্বা, একঢাল কালো কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল, পাকা গমের মত গায়ের রঙ- ওর এই সৌন্দর্যের
আকর্ষণকে উপেক্ষা করা সহজ ছিলনা কারও পক্ষে। আমরা ইয়ার্কি করে বলতাম, “এই যে এলেন সুপ্রিয়া দেবী’’! বিদিশা একটুও রাগ করত না, বরং
কোথায় যেন একটু গর্বও অনুভব করত। কলেজ লাইফের শেষ লগ্নে এসে বিদিশা একটা ছেলের
প্রেমে পড়েছিল শুনেছিলাম, পাড়ার বাউন্ডুলে মস্তান টাইপের ছেলে, তা নিয়ে বাড়ির সাথে
ওর বেশ ঝামেলা চলেছিল তাও জানতাম, অনেকদিন সেই খোঁজখবর নেওয়া হয়না। হঠাৎই খেলার
ছলে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, “ কি রে তোর সেই
হীরো জিৎ এর খবর কি?” বিদিশার মুখ এক
মুহূর্তে পালটে গেল। যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে এমন ভাবে বলল, “আমি ওর সাথে সব সম্পর্ক কাট আপ করেছি, অরুন্ধতী। কম বয়সের একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল ওটা। এখন বুঝেছি যে বিরাট ভুল করেছি। আজ আমি কয়েকটা
সিরিয়ালে অভিনয় করছি, আমার সামনে সুযোগ প্রচুর,
কিন্তু এই সম্পর্কের জন্য আমাকে সব জায়গায় পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রেম টেম কিছুনা,
ওর চাই শুধু টাকা। আমি পরিশ্রম করে টাকা আনবো, আর সেই টাকা আমাকে ওর হাতে তুলে
দিতে হবে মদ খাবার জন্য! অনেক হয়েছে, আর না!’’ একটু থেমে বিদিশা আবার বলে, “জানিস অরুন্ধতী, আমি শুধু ওর ম্যাচো ইমেজের জন্য ওকে
ভালবাসিনি, কি অসম্ভব ভালো ফুটবল খেলত ও তুই জানিস না! কিন্তু ওই যে বলে না,
হেরিডিটি! ওইখানেই গলদ। খেলা টেলা চুলোয় গেছে, এখন যতরকমের নেশা আছে, সবকিছুই ওর
সঙ্গী। আমি মুক্তি চাইছি অরুন্ধতী, কিন্তু ও আমাকে মুক্তি দেবেনা! আজ তুই আমার
সাথে আছিস বলে এই রাস্তা দিয়ে এসেছি, নাহলে কক্ষনো এই রাস্তা দিয়ে আসতাম না,
এখানেই ওদের আড্ডা! জানিস, আমার বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দেয় যে আমার সিরিয়াল করা
জন্মের মত ঘুচিয়ে দেবে।’’ বলতে বলতে
চোখ ভিজে আসে বিদিশার।
সান্ত্বনার স্বরে বলে উঠি, “কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’’। বলতে বলতেই সামনে তাকিয়ে দেখি একটা লোক এক হাতে
সাইকেল চালিয়ে সরাসরি আমাদের দিকেই আসছে! মাতাল
নাকি? বিদিশার চোখ ভিজে ছিল বলে হয়ত বোঝেনি, কিন্তু আমার বুঝতে বাকি রইল না যে ও
সোজা বিদিশার গায়ে এসে পড়বে। গোটা ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আমি কিছু আওয়াজ করতে
পারলাম না। সাইকেলটা যখন ফুট চারেক দূরে, আমি বিদিশাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলাম।
বিদিশা অনেক লম্বা! ওর মুখের দিকে তাক করে ছোড়া একরাশ ঘন তরল লক্ষভ্রষ্ট হয়ে
সরাসরি আছড়ে পড়ল আমার মুখের ডান দিকে। তীব্র যন্ত্রণায় অন্ধকার হয়ে গেল আমার
পৃথিবী!
*******
অপরূপ
অভিকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। ওর ফাইনাল প্রজেক্ট এর কি সব
কাজ চলছিল। কেউ কিচ্ছু জানায়নি অভিকে। জানায়নি, যে মুখ দেখতে ও একশো মাইল হেঁটে
আসতে পারে তা এখন কদর্য দেখতে হয়ে গেছে। নিজে হাতে পরপর সাতটা অপারেশন করেছিলেন
ডক্টর সমর মুখার্জি, আমাদের কলেজের সার্জারির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট। তাতে অ্যাসিড পোড়া চামড়াগুলোকে গ্রাফটিং করে অনেকটা
পালটে দিতে পারলেও আমার রূপ ফিরে আসল না। চোখটা কপাল গুনে বেঁচে গেছিল, কিন্তু পল্লবহীন চোখের পাতা যেন এই একদা স্নিগ্ধ
মুখটাকে মৃত মানুষের মত করে দিল। সদা হাস্যময় এই বাড়িতে যেন নেমে এল এক অভাবনীয়
নিস্তব্ধতা। আমার বুক ফেটে কান্না আসতো। যেদিন প্রথম নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
দেখলাম, মনে হল পৃথিবীর যত অন্ধকার যেন নেমে এসেছে আমার হৃদয়ে। মনে হল, কি পাপ আমি
করেছি এই জীবনে যে আমাকে এইভাবে অভিসপ্ত কদাকার হয়ে যেতে হল? আমার অভিকে এই মুখ
দেখাবো কি করে, কি করে অভি সহ্য করবে ওর তুলির এই কদাকার মুখ! ভাবতাম আর কাঁদতাম।
মা, বাবা, দাদারা, সবাই যেন একেকটা বিষাদমূর্তি। আমার মন রাখবার জন্য সবাই হাসছে,
আমাকে হাসাবার চেষ্টা করছে, ওরা ভুলে যেত যে আমি একজন ডাক্তার, আমাকে বোকা বানানো
সহজ নয়।
কিন্তু আমি এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এলাম। তার জন্য যার ঋণ
কোনদিনও পরিশোধযোগ্য নয় তিনি হলেন ডক্টর সুনির্মল সান্যাল, যিনি ছিলেন তৎকালীন
যুগের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট, আমাদের কলেজের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। আমাকে উনি
ভীষণ স্নেহ করতেন। সেই ডক্টর সান্যাল আমার বাড়িতে প্রায় রোজ আসতেন। বাস্তবিক, উনিই
আমাকে স্বাভাবিক করে তুললেন। আমার জীবনে এই শারীরিক পরিবর্তনকে সামলাবার জন্য যে
মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োজন তা ডক্টর সান্যাল আমার মনের মধ্যে রোপন করে দিলেন যেন। আমিও
ভাবতে শুরু করলাম, একটাই জীবন, হেলায় নষ্ট করবো কেঁদে কেঁদে আর দুঃখ করে! এত দুর্বল
আমি? ডক্টর সান্যাল শিখিয়েছিলেন, কি হবে যদি অভি আমার এই চেহারা কে প্রত্যাখ্যান
করে? বলেছিলেন, “যে মানুষ তোমার রূপ
দেখে তোমাকে ভালবাসে সে যদি সেই রূপ চলে যাবার পর তোমাকে ভালবাসতে না পারে তাহলে
সে কিরকম ভালবাসা? যদি এই দুর্ঘটনা তোমাদের বিয়ের পর হত তখন সে কি করত? ত্যাগ করত তোমায়?
তাহলে তো এটাই জানতে হবে যে এই মানুষ তোমার জীবনে আসেনি, তুমি লাকি। তাই নয়?’’ এত কিছু বোঝাবার দরকার ছিলনা আমায়।
বাবা, মা, দাদারা, কাকু, কাকিমণি সবার চিন্তা একটাই- অভি কি এই কুরূপা, কদাকার
তুলিকে আপন করবে? যদি না করে? তুলি কি ভাবে সহ্য করবে এই শোক!
ওরা হয়ত স্বাভাবিক চিন্তাই করছিলেন, কিন্তু ওরা আমার
অভিকে আমার মত চিনত না। বিশ্বাস কেউ করবে কিনা জানিনা, আমার চিন্তা ছিল অন্য। আমার
এই কুৎসিত প্রায় মুখ নিয়েও আমি ভাবতাম, “অভি, তুমি তোমার তুলির এই মুখ সহ্য
করতে পারবে কি করে গো? তুমি পাগল হয়ে যাবে না তো?’’ এই চিন্তাতে আমি বিহ্বল হয়ে থাকতাম। হয়ত সবাই ভাববে যে
আমি অতিশয়োক্তি করছি, কিন্তু আমার অন্তরাত্মা জানে যে আমি যা বলছি তাই ভাবতাম আমি।
অবশেষে অভির পরীক্ষা মিটলে, এবং আমি উঠে চলাফেরা কিছুটা
করতে পারলে ওকে জানানো হল ভাসাভাসা করে। বলা হল যে তুলির একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, এখন
ঠিক আছে। অভি শুধু বলেছিল, “তুলিকে দাও, আমি
শুধু একবার ওর সাথে কথা বলতে চাই।’’ ফোনের ওপার
থেকে শুধু আমার গলার আওয়াজটুকু পেয়েই অভি বলল, “আমি আসছি, তুমি শুধু এইটুকু বল যে তুমি ঠিক আছো?’’ আমি শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, “আছি, তুমি চিন্তা কোরোনা।’’ আবারো অভি বলল, “আমি আসছি তুলি।’’
আজ এসেছে অভি। এয়ারপোর্ট থেকে রাঙাদাদা ওকে নিয়ে আসতে
গেছিল। হয়ত বাড়ি আসার পথে দাদা কিছুটা আভাস দিয়েছিল অভিকে। বাড়িতে ঢুকে সোজা আমার
ঘরে ঢুকেছিল অভি। মা আমার মুখে একটা কাপড় চাপা দিতে চেয়েছিল, আমিই না করলাম। মা আমার
মাথার কাছে, আমি খাটে আধশোয়া হয়ে, বাবা একটা চেয়ারে বসেছিল, মাঝে মাঝে উঠছে, আবার
বসছে, অস্থিরভাবে। রাঙাদাদা অভিকে হাত ধরে ঘরের দরজার সামনে ছেড়েই কোথায় বেড়িয়ে
গেল। দরজার পর্দা সরিয়ে অভি ঘরে ঢুকল। এক ঝলক দেখল আমাকে, যেন কারেন্ট এর শক
খেয়েছে এমনভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। অভির এইভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে যাওয়া দেখে ডুকরে
কেঁদে উঠল মা। বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল মাথা নীচু করে। রাঙাদাদা বাইরে কোথাও
অপেক্ষা করছিল, প্রথমে অভিকে দৌড়ে বেড়োতে দেখে, পরে বাবাকেও বেড়িয়ে যেতে দেখে দৌড়ে
ঘরে ঢুকল। মায়ের কাছে গিয়ে সান্ত্বনার স্বরে বলে উঠল, “কেঁদোনা জেঠিমা, আমরা আছিতো।’’
মা’র মাথায় হাত রেখে
বললাম, “কেঁদোনা মা, কিচ্ছু
হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ দাদাকে
বললাম, “আমাকে একটু ধরবি
দাদা, আমি একটু বাইরে যাবো।’’ রাঙাদাদার
চোখেও জল, ও ইতস্ততঃ করতে লাগলো। ওকে আস্বস্ত করে বললাম, “আমি একটু ছাদে যাবো, নিয়ে যাবি দাদা?’’ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রাঙাদাদা
কিচ্ছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। আমি দাদার হাত ধরে আস্তে আস্তে ছাদের সিঁড়ি ভেঙ্গে
উঠতে লাগলাম।
ছাদের কার্নিশ এর উপর মাথা সম্পূর্ণ ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
অভি। লম্বা শরীরটা কাঁপছে। কাঁদছে আমার অভি। আমি জানতাম এটাই করবে ও। সবার সামনে
কাঁদতে পারবেনা, তাই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে ঘর থেকে। কাঁদছে আমার অভি, ওর তুলির চেহারা
দেখে ওর চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেছে। আস্তে ওর পিছনে এসে ওর পিঠে মাথা রাখলাম আমি।
এই পরশে যেন বাঁধের শেষ আগল টাও ভেঙে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার মাথাকে ওর বুকের সাথে
মিশিয়ে নিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো অভি। এতদিন আমি কাঁদতে ভুলে গেছিলাম, অভি’র চোখের জলে আমার মাথা ভিজে যাচ্ছে,
কোথা থেকে যেন এক রাশ কান্না আমার চোখ দিয়ে স্রোতের মত বেয়ে আসতে লাগলো, ভিজে গেল
অভির জামা। আমার কষ্ট হচ্ছিল, তবুও যে অপার্থিব সুখে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি, তার কাছে
এই কষ্ট কিচ্ছু না। আমি হেরে যাইনি, আমি তোমাকে ঠিক চিনেছি, আমি হেরে যাইনি, আমার
ভালোবাসা হেরে যায়নি! কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানিনা, অভির বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে
কাঁদতে বলে উঠলাম, “এই মুখ দেখতে আর
তোমায় একশ মাইল হেঁটে আসতে হবে না গো কোনদিন!’’ আমার কথা শেষ হতেও পারল না, আমার কদাকার মুখটাকে নিজের
দুই হাতে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁট দিয়ে ভিজিয়ে দিতে লাগলো অভি। পাগলের মত।
সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমার রাত ছিলনা। তবুও এক অদৃশ্য
অপার্থিব মায়াবি জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল পৃথিবী। শত শত পারিজাতের পাপড়ি তাদের
স্বর্গীয় সুবাস নিয়ে যেন স্বর্গ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো একাত্বে বিলীন হয়ে যাওয়া দুটি
পার্থিব শরীরের উপর।
*******
২০ বছর পরঃ
অরুন্ধতী, অভিলাষের ফুলের মতন দুটি সন্তান। । এক ছেলে, এক মেয়ে। অভিনন্দন ও
অরুণিমা। অরুন্ধতী ও অভিলাষ দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। অরুন্ধতী শহরের নামকরা মনোরোগ
বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। অভিলাষ ১৮ বছর একটি বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চ পদে আসীন
থেকে গত বছর চাকরী থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠন করেছে। সে এই
সংস্থার সর্বক্ষণের ডিরেক্টর হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। ‘অপরূপা’ ওদের দুজনের স্বপ্নের এক ফসল।
অ্যাসিড আক্রান্তদের মানসিক ও সামাজিক পূণর্গঠনের কাজে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য
আজ এই সংস্থার দেশজোড়া খ্যাতি।
*******
সমাপ্ত