Search This Blog

Wednesday, 23 August 2017

রূপ কুরূপ অপরূপ



(এক সত্যি ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লেখা)
একটু আগেই ঘর থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গেছে অভি, বলা ভালো পালিয়ে গেছে। আমার ভীষণ ভয় করছে, ওর জন্য, কিন্তু আমার কথা কে শুনবে এখন! সবাই আমাকে আগলিয়ে রেখেছে, মুখচোখে এমন ভাব যেন কি একটা ঝড় বোধহয় বয়ে গিয়েছে একটু আগে, আর চারদিকে ছড়িয়ে রেখে গেছে ধ্বংসস্তুপের পাহাড়! আর সেই ধ্বংসস্তুপের মাঝে আমার মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন কেমন যেন প্রাণহীন এক একটা প্রস্তরখন্ডের মত এলোমেলো, অবিন্যস্ত পড়ে আছে। মার মুখ দিয়ে মৃদু স্বরে ডুকরে কান্নার আওয়াজ আসছে। আমার খুব খারাপ লাগছে ওদের জন্য। কিন্তু, আমি কিছু বলতেও পারছি না,  বলার মত তেমন অবস্থাও নেই যদিও এখন আমার! বারান্দায় একমাত্র মুনিয়া শুধুমাত্র একনাগাড়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করে যাচ্ছে। এই অসহ্য নীরবতার মাঝে মুনিয়ার আওয়াজ আর মার কান্নার আওয়াজ পরিবেশকে কেমন যেন শোকাচ্ছান্ন করে তুলেছে।
রূপ
ছোটবেলা থেকে সবাই আমার চোখের খুব প্রশংসা করত। বন্ধুরা বলত আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নাকি কারও মনে কোন পাপবোধ আসবেনা, এমনই স্নিগ্ধ ছিল নাকি আমার টানাটানা চোখদুটি। সবার কাছে শুনি যে বাড়িতে মেয়ে হলে নাকি কারো কারো মুখ কালো হয়। মার কাছে শুনেছি, আমি হবার পর এই বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। অনেক ভাইয়ের পরে আমি ছিলাম প্রথম বোন। স্বভাবতই আমার আদরের কোনও তুলনা ছিলনা। বাবা সখ করে নাম রেখেছিলেন অরুন্ধতীপরে বন্ধুরা বলত, আচ্ছা কাকাবাবু কিকরে জানলেন বলত যে তুই সত্যি সত্যি অরুন্ধতী দেবীর মতন দেখতে হবি? সত্যি কি না জানিনা তবে এই কথা আমি বন্ধুরা ছাড়াও অন্য অনেককে বলতে শুনেছি। বাবা বলতো, তুই আমার আকাশে ভোরের তারা, তাই অরুন্ধতী’’। অভিকে জিজ্ঞাসা করলে বলতো, সে আমি জানিনা, আমি শুধু জানি যে এই মুখ দেখতে আমি একশো মাইল হেঁটে আসতে পারি।’’ লজ্জা পেতাম, আবার ভীষণ ভালোও লাগতো। অভির মুখে এই কথা শুনতে শুনতে মনে হোত যে আমি পাখী হয়ে উড়ে চলেছি নীল আকাশের মাঝে সাদা পেঁজা তুলোর মত ভেসে চলা মেঘের মধ্যে দিয়ে! মুখে বলতাম, ধ্যাত, তুমি না!’’ অভিকে কবে থেকে তুই থেকে তুমি বলা শুরু করেছি আজও মনে করতে পারি আমি
সেই সময়টা যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের এত রমরমা ছিলনা, তবু আমি ছোটবেলা থেকেই শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই পড়েছি। অভি ভরতি হল কয়েক বছর পর, যখন ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে কলকাতা এলেন দিল্লী থেকে। অভির বাবা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবার সুপারিশেই অভিকে আমাদের স্কুলে ভরতি করালেন ওর বাবা।
অভি আমার বন্ধু হয়ে উঠল কি করে তা আশ্চর্য ঘটনা। স্বভাবগত ভাবে আমার ঠিক বিপরীত ছিল ওআমি ছোট থেকেই ভীষণ চঞ্চল, ডানপিটে। ক্লাসে বরাবর প্লেস পেতাম বলে টীচাররা ভালবাসতেন খুব, তাই হয়ত কোনোদিন গার্জেন কল’’ হয়নি, কিন্তু তাই বলে আমার দুষ্টুমির খবর যে ওঁরা রাখতেন না তাও নয়। প্রশ্রয় দিতেন হয়ত, জানিনা। অভি ছিল চুপচাপ, একটু ইন্ট্রোভার্ট, সবসময় মুখ গুজে হয় বই পড়ছে অথবা জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে এই স্কুলে ভরতি হবার জন্য, নাকি ছোট থেকে মায়ের স্নেহ না পাবার জন্য বুঝতে পারতাম না তখন, ও এমনই ছিল। পরে বুঝেছিলাম যে, মা না থাকার যন্ত্রণাকে ও ভুলতে পারতনা। আমার মা কে যে ও কি ভালবাসত তা আমি বোঝাতে পারবনা। যখন অভিরা দিল্লী থেকে কলকাতায় এল, বাবার কাছ থেকে সব শুনে মা বাবাকে বলল, অরুণ ঠাকুরপোকে বলে তুমি ওকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসবে আমার কাছে । আহা রে, এইটুকু ছেলে, এই ছোট বয়সে মা হারা হবার কষ্ট কেন দিলে ওকে ভগবান!’’ মাকে মায়ের মত ভাবা সেই শুরু। মা ও তার অপত্য স্নেহ উজার করে দিয়েছিল অভিকে। এই বাড়িরই ছেলে হয়ে উঠেছিল অভি। এমনকি আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের দাদাদেরও ভীষণ প্রিয় পাত্র ছিল ও।
এইপ্রথম আমাকে কেউ রিয়েল চ্যালেঞ্জ এর সামনে ফেললো। ক্লাস ফোর এর অ্যানুয়াল রেজাল্টে অভি ফার্স্ট হল, আমি হলাম সেকেন্ড। সবাই ভাবতে শুরু করল, এইবার বোধহয় অরুন্ধতী আর অভিলাষের মধ্যে রেষারেষি শুরু হবে। হয়নি।  আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। তবুও কিভাবে যেন আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত কেমিষ্ট্রি তৈরী হয়ে গেল। অভির সব কথা শুধুমাত্র আমার সাথে, রাগ হলেও আমি, অভিমান হলেও আমি, কিছু খেতে ইচ্ছে হলেও আমি, কোথাও যেতে হলেও আমিআস্তে আস্তে আমি যেন ওর সব না বলা কথাগুলো ওর মুখ দেখেই বুঝে ফেলতে পারতাম। হয়ত দুই বাড়ির সম্পর্ক টা একটা ফ্যাক্টর ছিল, হয়ত মার অভির প্রতি অত্যধিক অপত্যস্নেহটা একটা কারণ ছিল, তবুও কিন্তু কোনদিনও অন্য কোন অনুভূতি মাথায় আসেনি। এমনকি ক্লাসের সবাই জানত যে অভিলাষ ও অরুন্ধতী সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
কোনদিন আমি অভিকে আমার কম্পিটিটর ভাবিনি, বরং ও আমাকে ছাপিয়ে গেলে আমার কেন জানিনা ভালো লাগত। কেন ভালো লাগত তা বুঝলাম যখন প্রথম আমাকে ছেড়ে চলে গেল খড়গপুরে, এইচ এসের পর। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আমি চান্স পেলাম সি এম সি এইচ এ। আমার বাড়িতে আমার দাদু ডাক্তার, আমার কাকু ডাক্তার, আমার রাঙাদা ডাক্তার। ডাক্তারি আমাদের বংশে। আমার ডাক্তার না হলে চলে? এটা ঠিক বলে বোঝাতে পারবনা, তবে পরিবারে অনেক ডাক্তার থাকলে কেন জানিনা পরোক্ষে ডাক্তারির দিকে একটা ঝোঁক এসেই যায়।
সেই প্রথম অভিকে অনেকদিন না দেখে থাকা। ডাক্তারী পড়ার প্রথম বছর। অথচ অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি কিছুতেই মন বসাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে কি যেন নেই আমার। মনটা মাঝে মাঝে হু হু করে উঠছে! তখন তো মোবাইলের সুবিধা চালু হয়নি! যদিও অভি মাসে একদিন দুইদিন বাড়িতে ফোন করে মার সাথে কথা বলত, কিন্তু কখনো আমাকে চায়নি। খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা যদিও, তবুও চায়নি। মা ই একদিন বলল, তুলির সাথে কথা বলবি অভি, ও পাশেই আছে।’’ আমি বলেছিলাম, আমার সাথে কি কথা? আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে যে আমাকে ফোন দিচ্ছ? মা হেসে বলেছিল, এই দেখ, মেয়ের রাগ হয়েছে, নে কথা বল তোরা।’’ বলেই ফোনটা আমার হাতে দিয়ে মা নিজের কাজে চলে গেছিল। ফোন হাতে নিয়ে আমি কোন কথা বলছিলাম না, সত্যিই আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।
একটু পরে বললাম, কিছু কথা বলবি না ফোন রাখব?’’ একটু থেমে অভি বলল, তোকে ছাড়া সারা জীবন কাটাবো কি করে তুলি?’’
- হ্যাঁ, তার জন্যই তো একবারও খোঁজ করিস না!’’
-দেখছিলাম রে, তোকে ভুলে থাকতে পারি কিনা
-পেরেছিস তো।
-পারছিনা রে, মনে হচ্ছে আমার হার্ট টাই নেই আমার বুকের ভিতর। এতদিন তুই সাথে সাথে ছিলিস, কখনো বুঝিনি যে আমি এতটা অসম্পূর্ণ’’
-আমারো পড়াতে মন বসছে না রে অভি, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়’’, আগেই বলেছিলাম যে  অদ্ভূত এক কেমিষ্ট্রি ছিল আমাদের মধ্যে, রাগ করে থাকা সম্ভব ছিলনা। কিন্তু সেইদিন এই জীবনে প্রথম অভিকে কেমন অসহায়ের মতন লাগলর গলার স্বর এই প্রথম কেমন যেন কেঁপে উঠল কথা বলতে বলতে।
খড়্গপুর থেকে পূজার ছুটিতে এসেছিল অভি। সেদিন ছিল কোজাগরী লক্ষীপূজার রাত। আমাদের বাড়িতে বিরাট করে পূজা হত। ভোগ হত। শাড়ি পড়েছিলাম আমি একটা, মায়ের জামদানী। ঠাকুরমশাই আশীর্ব্বাদ করে বললেন, রাজরাণী হও মা।’’ প্রসাদ দিতে গিয়ে দেখি অভি নেই। কোথায় গেল ছেলেটা! একটু আগেই তো রাঙাদাদার সাথে কথা বলছিল! প্রসাদের থালা হাতে উঠে এলাম ছাদে। আমি জানতাম একা এইখানে ছাড়া কোত্থাও যাবেনা ও। ছাদে পা দিয়েই মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। চারপাশে কেমন এক অদ্ভূত শান্ত শীতলতা। সারা ছাদ ভেসে যাচ্ছে কোজাগরী পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার মায়াবী মধুর আলোছায়ায়। পৃথিবীকে আগে কখনও এত মোহময়ী লাগেনিতো! ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে অভি। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠছিলাম আমি, আমার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে, এই অপরূপ পরিবেশে আমার চঞ্চলতাও কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেল। আস্তে ডাকলাম, অভি’’
-আয়।’’
একেইকি বলে মোহাবিষ্ট হয়ে যাওয়া! না কি সারা শরীরের সমস্ত স্বত্বা কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে এমনভাবেই আচ্ছন্ন হয়ে যায়! আমি আস্তে আস্তে ওর সামনে এসে দাঁড়ালাম। প্রসাদের থালাটা আমার হাত থেকে নিয়ে ছাদের আলশের উপর রেখে পরম মমতায় আমার হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিল অভিযেন বুকের গভীরতম স্থান থেকে কিছু বলছে এমনভাবে বলল, একটা জিনিস চাইবো তুলি?’’
আমি কি বলব? আমার সারা শরীরে হাজার আলোর ঝরণা সন্তুরের সুরের মত রোশনাই জ্বেলে শিরা উপশিরা দিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে চলেছে, আমি স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে আছি। যেন আমি এই জগতের কেউ নেই, আমার মন এক অপার আনন্দের ভালো লাগায় ভেসে যাচ্ছে, অথচ আমি সম্মোহিতের মত বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি!
অভি এক অদ্ভূত কান্ড করল। আমার হাতদুটোকে নিজের হাতে নিয়েই আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, মুখ তুলে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, আমি অনেক ভেবে দেখছি তুলি, তোকে ছাড়া আমি কেউনা রে, তুই ছাড়া আমি শূণ্য। আমাকে সম্পূর্ণ করে নিবি তুলি? আমার বউ হবি?’’ কি বলব আমি, আমার অবচেতন মনের না বলা কথাগুলো অভি বলে দিল যে! অদ্ভুত ভাললাগা শরীরে শিহরণ তুলে দিচ্ছে, বাইরের জ্যোৎস্নার আলো আমার শরীর মনকে ভিতর থেকে ধুইয়ে দিচ্ছে, তবু আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ আমি করতে পারছি না। শুধু বললাম, অভি’’! দুই হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে মুখ গুঁজে দিল অভি। আমি কেঁপে উঠলাম। নিজেকে সমর্পনের সাক্ষী হয়ে থাকল কোজাগরীর ওই চাঁদ। এক সময় ওর মুখ ধরে বললাম, ওঠো।’’ আমার হাত ভিজে গেল। অভির চোখের জলে। এত ভালবাসে আমাকে? আমাকে নিজের করে পাবার আনন্দে ওর চোখে জল আসে! কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি! নিজেকে সত্যি রাজরাণী মনে হল। পাগলের মত আঁকড়ে ধরলাম অভিকে। অনন্তকাল যেন কেটে গেল। আমার মুখটা নিজের দুই হাতে তুলে নিয়ে আমার কপালের ঠিক মাঝখানে ঠোঁট রাখল অভি। কেঁপে উঠলাম আমি। বুঝলাম, দুটি হৃদয় যখন একই সুরে অনুরণিত হয় তখন এই পৃথিবীতেই স্বর্গ নেমে আসে। মনের মানুষ কে নিজের করে পাবার, তার মনকে সম্পূর্ণ করে পাবার যে উপলব্ধি তা স্বর্গীয় এক ফুলের সুবাস ছড়ায়, মনকে অনন্য পবিত্রতায় ভরিয়ে তোলে।
*******
কুরূপ
বিদিশা আর আমি ফিরছিলাম। আর কয়দিন পরেই আমার বিয়ে। অভি ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে এম টেক করছেবি টেক করার পর আমেরিকা গেছিল চাকরী নিয়ে। চাকরী করতে করতেই ওর মনে হয়েছে যে এম টেক টাও করে নেওয়া জরুরী। চাকরী করতে করতে ওদের দেশে নাকি এমন করা যায়। আমি অবশ্য আমার ডাক্তারী ছাড়া কিছু বুঝিনা, মাথা ঘামাবার ও প্রয়োজন নেই। আমার এম ডি পরীক্ষার ফাইনাল সবে শেষ হয়েছে। এখন কয়েকদিন ছুটি। যদিও হাসপাতালে যেতেই হয়, তবুও সেদিন যাইনি। পুরনো বন্ধুরা সব এক জায়গায় বসে খুব আড্ডা দেব, এই ছিল প্ল্যান। জয়তী, একটা নামকরা মেয়েদের কলেজের লেকচারার, বিয়ে টিয়ে করবে না (কারণ টা আমি জানি কিন্তু এখানে বলার দরকার নেই), দমদম এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেটে ফ্ল্যাট কিনেছে, সেখানেই আমাদের গেট টুগেদার। বিদিশা আমার স্কুল লাইফের বন্ধু। আমাদের ঠিক পাশের পাড়াতেই ওদের বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। পড়াশোনায় তেমন কিছু না হলেও যে কারণে বিদিশা জনপ্রিয় ছিল তা হল ওর অভিনয়। অসামান্য অভিনয় করতো ও। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা, একঢাল কালো কুচকুচে কোঁকড়ানো চুল, পাকা গমের মত গায়ের রঙ- ওর এই সৌন্দর্যের আকর্ষণকে উপেক্ষা করা সহজ ছিলনা কারও পক্ষে। আমরা ইয়ার্কি করে বলতাম, এই যে এলেন সুপ্রিয়া দেবী’’! বিদিশা একটুও রাগ করত না, বরং কোথায় যেন একটু গর্বও অনুভব করত। কলেজ লাইফের শেষ লগ্নে এসে বিদিশা একটা ছেলের প্রেমে পড়েছিল শুনেছিলাম, পাড়ার বাউন্ডুলে মস্তান টাইপের ছেলে, তা নিয়ে বাড়ির সাথে ওর বেশ ঝামেলা চলেছিল তাও জানতাম, অনেকদিন সেই খোঁজখবর নেওয়া হয়না। হঠাৎই খেলার ছলে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, কি রে তোর সেই হীরো জিৎ এর খবর কি? বিদিশার মুখ এক মুহূর্তে পালটে গেল। যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে এমন ভাবে বলল, আমি ওর সাথে সব সম্পর্ক কাট আপ করেছি, অরুন্ধতীকম বয়সের একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল ওটাএখন বুঝেছি যে বিরাট ভুল করেছি। আজ আমি কয়েকটা সিরিয়ালে অভিনয় করছি, আমার সামনে সুযোগ প্রচুর, কিন্তু এই সম্পর্কের জন্য আমাকে সব জায়গায় পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রেম টেম কিছুনা, ওর চাই শুধু টাকা। আমি পরিশ্রম করে টাকা আনবো, আর সেই টাকা আমাকে ওর হাতে তুলে দিতে হবে মদ খাবার জন্য! অনেক হয়েছে, আর না!’’ একটু থেমে বিদিশা আবার বলে, জানিস অরুন্ধতী, আমি শুধু ওর ম্যাচো ইমেজের জন্য ওকে ভালবাসিনি, কি অসম্ভব ভালো ফুটবল খেলত ও তুই জানিস না! কিন্তু ওই যে বলে না, হেরিডিটি! ওইখানেই গলদ। খেলা টেলা চুলোয় গেছে, এখন যতরকমের নেশা আছে, সবকিছুই ওর সঙ্গী। আমি মুক্তি চাইছি অরুন্ধতী, কিন্তু ও আমাকে মুক্তি দেবেনা! আজ তুই আমার সাথে আছিস বলে এই রাস্তা দিয়ে এসেছি, নাহলে কক্ষনো এই রাস্তা দিয়ে আসতাম না, এখানেই ওদের আড্ডা! জানিস, আমার বাড়ি বয়ে এসে হুমকি দেয় যে আমার সিরিয়াল করা জন্মের মত ঘুচিয়ে দেবে।’’ বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে বিদিশার।
সান্ত্বনার স্বরে বলে উঠি, কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’’বলতে বলতেই সামনে তাকিয়ে দেখি একটা লোক এক হাতে সাইকেল চালিয়ে সরাসরি আমাদের দিকেই আসছে! মাতাল নাকি? বিদিশার চোখ ভিজে ছিল বলে হয়ত বোঝেনি, কিন্তু আমার বুঝতে বাকি রইল না যে ও সোজা বিদিশার গায়ে এসে পড়বে। গোটা ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে আমি কিছু আওয়াজ করতে পারলাম না। সাইকেলটা যখন ফুট চারেক দূরে, আমি বিদিশাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলাম। বিদিশা অনেক লম্বা! ওর মুখের দিকে তাক করে ছোড়া একরাশ ঘন তরল লক্ষভ্রষ্ট হয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ল আমার মুখের ডান দিকে। তীব্র যন্ত্রণায় অন্ধকার হয়ে গেল আমার পৃথিবী!
*******
অপরূপ
অভিকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। ওর ফাইনাল প্রজেক্ট এর কি সব কাজ চলছিল। কেউ কিচ্ছু জানায়নি অভিকে। জানায়নি, যে মুখ দেখতে ও একশো মাইল হেঁটে আসতে পারে তা এখন কদর্য দেখতে হয়ে গেছে। নিজে হাতে পরপর সাতটা অপারেশন করেছিলেন ডক্টর সমর মুখার্জি, আমাদের কলেজের সার্জারির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টতাতে অ্যাসিড পোড়া চামড়াগুলোকে গ্রাফটিং করে অনেকটা পালটে দিতে পারলেও আমার রূপ ফিরে আসল না। চোখটা কপাল গুনে বেঁচে গেছিল, কিন্তু পল্লবহীন চোখের পাতা যেন এই একদা স্নিগ্ধ মুখটাকে মৃত মানুষের মত করে দিল। সদা হাস্যময় এই বাড়িতে যেন নেমে এল এক অভাবনীয় নিস্তব্ধতা। আমার বুক ফেটে কান্না আসতো। যেদিন প্রথম নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, মনে হল পৃথিবীর যত অন্ধকার যেন নেমে এসেছে আমার হৃদয়ে। মনে হল, কি পাপ আমি করেছি এই জীবনে যে আমাকে এইভাবে অভিসপ্ত কদাকার হয়ে যেতে হল? আমার অভিকে এই মুখ দেখাবো কি করে, কি করে অভি সহ্য করবে ওর তুলির এই কদাকার মুখ! ভাবতাম আর কাঁদতাম। মা, বাবা, দাদারা, সবাই যেন একেকটা বিষাদমূর্তি। আমার মন রাখবার জন্য সবাই হাসছে, আমাকে হাসাবার চেষ্টা করছে, ওরা ভুলে যেত যে আমি একজন ডাক্তার, আমাকে বোকা বানানো সহজ নয়।
কিন্তু আমি এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে এলাম। তার জন্য যার ঋণ কোনদিনও পরিশোধযোগ্য নয় তিনি হলেন ডক্টর সুনির্মল সান্যাল, যিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট, আমাদের কলেজের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব। আমাকে উনি ভীষণ স্নেহ করতেন। সেই ডক্টর সান্যাল আমার বাড়িতে প্রায় রোজ আসতেন। বাস্তবিক, উনিই আমাকে স্বাভাবিক করে তুললেন। আমার জীবনে এই শারীরিক পরিবর্তনকে সামলাবার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োজন তা ডক্টর সান্যাল আমার মনের মধ্যে রোপন করে দিলেন যেন। আমিও ভাবতে শুরু করলাম, একটাই জীবন, হেলায় নষ্ট করবো কেঁদে কেঁদে আর দুঃখ করে! এত দুর্বল আমি? ডক্টর সান্যাল শিখিয়েছিলেন, কি হবে যদি অভি আমার এই চেহারা কে প্রত্যাখ্যান করে? বলেছিলেন, যে মানুষ তোমার রূপ দেখে তোমাকে ভালবাসে সে যদি সেই রূপ চলে যাবার পর তোমাকে ভালবাসতে না পারে তাহলে সে কিরকম ভালবাসা? যদি এই দুর্ঘটনা তোমাদের বিয়ের পর হত তখন সে কি করত? ত্যাগ করত তোমায়? তাহলে তো এটাই জানতে হবে যে এই মানুষ তোমার জীবনে আসেনি, তুমি লাকি। তাই নয়?’’ এত কিছু বোঝাবার দরকার ছিলনা আমায়। বাবা, মা, দাদারা, কাকু, কাকিমণি সবার চিন্তা একটাই- অভি কি এই কুরূপা, কদাকার তুলিকে আপন করবে? যদি না করে? তুলি কি ভাবে সহ্য করবে এই শোক!
ওরা হয়ত স্বাভাবিক চিন্তাই করছিলেন, কিন্তু ওরা আমার অভিকে আমার মত চিনত না। বিশ্বাস কেউ করবে কিনা জানিনা, আমার চিন্তা ছিল অন্য। আমার এই কুৎসিত প্রায় মুখ নিয়েও আমি ভাবতাম,  অভি, তুমি তোমার তুলির এই মুখ সহ্য করতে পারবে কি করে গো? তুমি পাগল হয়ে যাবে না তো?’’ এই চিন্তাতে আমি বিহ্বল হয়ে থাকতাম। হয়ত সবাই ভাববে যে আমি অতিশয়োক্তি করছি, কিন্তু আমার অন্তরাত্মা জানে যে আমি যা বলছি তাই ভাবতাম আমি।
অবশেষে অভির পরীক্ষা মিটলে, এবং আমি উঠে চলাফেরা কিছুটা করতে পারলে ওকে জানানো হল ভাসাভাসা করে। বলা হল যে তুলির একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, এখন ঠিক আছে। অভি শুধু বলেছিল, তুলিকে দাও, আমি শুধু একবার ওর সাথে কথা বলতে চাই।’’ ফোনের ওপার থেকে শুধু আমার গলার আওয়াজটুকু পেয়েই অভি বলল, আমি আসছি, তুমি শুধু এইটুকু বল যে তুমি ঠিক আছো?’’ আমি শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, আছি, তুমি চিন্তা কোরোনা।’’ আবারো অভি বলল, আমি আসছি তুলি।’’
আজ এসেছে অভি। এয়ারপোর্ট থেকে রাঙাদাদা ওকে নিয়ে আসতে গেছিল। হয়ত বাড়ি আসার পথে দাদা কিছুটা আভাস দিয়েছিল অভিকে। বাড়িতে ঢুকে সোজা আমার ঘরে ঢুকেছিল অভি। মা আমার মুখে একটা কাপড় চাপা দিতে চেয়েছিল, আমিই না করলাম। মা আমার মাথার কাছে, আমি খাটে আধশোয়া হয়ে, বাবা একটা চেয়ারে বসেছিল, মাঝে মাঝে উঠছে, আবার বসছে, অস্থিরভাবে। রাঙাদাদা অভিকে হাত ধরে ঘরের দরজার সামনে ছেড়েই কোথায় বেড়িয়ে গেল। দরজার পর্দা সরিয়ে অভি ঘরে ঢুকল। এক ঝলক দেখল আমাকে, যেন কারেন্ট এর শক খেয়েছে এমনভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। অভির এইভাবে দৌড়ে বেড়িয়ে যাওয়া দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল মা। বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল মাথা নীচু করে। রাঙাদাদা বাইরে কোথাও অপেক্ষা করছিল, প্রথমে অভিকে দৌড়ে বেড়োতে দেখে, পরে বাবাকেও বেড়িয়ে যেতে দেখে দৌড়ে ঘরে ঢুকল। মায়ের কাছে গিয়ে সান্ত্বনার স্বরে বলে উঠল, কেঁদোনা জেঠিমা, আমরা আছিতো।’’
মার মাথায় হাত রেখে বললাম, কেঁদোনা মা, কিচ্ছু হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ দাদাকে বললাম, আমাকে একটু ধরবি দাদা, আমি একটু বাইরে যাবো।’’ রাঙাদাদার চোখেও জল, ও ইতস্ততঃ করতে লাগলো। ওকে আস্বস্ত করে বললাম, আমি একটু ছাদে যাবো, নিয়ে যাবি দাদা?’’ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রাঙাদাদা কিচ্ছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। আমি দাদার হাত ধরে আস্তে আস্তে ছাদের সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে লাগলাম।
ছাদের কার্নিশ এর উপর মাথা সম্পূর্ণ ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভি। লম্বা শরীরটা কাঁপছে। কাঁদছে আমার অভি। আমি জানতাম এটাই করবে ও। সবার সামনে কাঁদতে পারবেনা, তাই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে ঘর থেকে। কাঁদছে আমার অভি, ওর তুলির চেহারা দেখে ওর চোখের জলের বাঁধ ভেঙে গেছে। আস্তে ওর পিছনে এসে ওর পিঠে মাথা রাখলাম আমি। এই পরশে যেন বাঁধের শেষ আগল টাও ভেঙে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার মাথাকে ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো অভি। এতদিন আমি কাঁদতে ভুলে গেছিলাম, অভির চোখের জলে আমার মাথা ভিজে যাচ্ছে, কোথা থেকে যেন এক রাশ কান্না আমার চোখ দিয়ে স্রোতের মত বেয়ে আসতে লাগলো, ভিজে গেল অভির জামা। আমার কষ্ট হচ্ছিল, তবুও যে অপার্থিব সুখে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি, তার কাছে এই কষ্ট কিচ্ছু না। আমি হেরে যাইনি, আমি তোমাকে ঠিক চিনেছি, আমি হেরে যাইনি, আমার ভালোবাসা হেরে যায়নি! কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানিনা, অভির বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম, এই মুখ দেখতে আর তোমায় একশ মাইল হেঁটে আসতে হবে না গো কোনদিন!’’ আমার কথা শেষ হতেও পারল না, আমার কদাকার মুখটাকে নিজের দুই হাতে তুলে নিয়ে ওর ঠোঁট দিয়ে ভিজিয়ে দিতে লাগলো অভিপাগলের মত।
সেদিন কোজাগরী পূর্ণিমার রাত ছিলনা। তবুও এক অদৃশ্য অপার্থিব মায়াবি জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল পৃথিবী। শত শত পারিজাতের পাপড়ি তাদের স্বর্গীয় সুবাস নিয়ে যেন স্বর্গ থেকে ঝরে পড়তে লাগলো একাত্বে বিলীন হয়ে যাওয়া দুটি পার্থিব শরীরের উপর।
*******
২০ বছর পরঃ
অরুন্ধতী, অভিলাষের ফুলের মতন দুটি সন্তান। । এক ছেলে, এক মেয়ে। অভিনন্দন ও অরুণিমা। অরুন্ধতী ও অভিলাষ দুজনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। অরুন্ধতী শহরের নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। অভিলাষ ১৮ বছর একটি বহুজাতিক সংস্থায় উচ্চ পদে আসীন থেকে গত বছর চাকরী থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠন করেছে। সে এই সংস্থার সর্বক্ষণের ডিরেক্টর হিসাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে।  অপরূপা ওদের দুজনের স্বপ্নের এক ফসল। অ্যাসিড আক্রান্তদের মানসিক ও সামাজিক পূণর্গঠনের কাজে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য আজ এই সংস্থার দেশজোড়া খ্যাতি।
*******
সমাপ্ত

Tuesday, 15 August 2017

হায় স্বাধীনতা

 হায় স্বাধীনতা

দেশদ্রোহী! স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার আওয়াজ তুলেছো তুমি ?
জানিস নাকি তোদের জন্য অপেক্ষমান কঠোর বধ্যভূমি 
এতই বোকা
তোরা কি সকলে সত্যি সত্যি এতই বোকা!

দেশদ্রোহী! সীমান্তে সেনা বুক চিতিয়ে লড়ছে, মরছে, সে খবর কি জানা ?
সকলের হাতে কাজ চাই বলে স্লোগান তোলা তোদের কাঙালপনা
এই অসময়ে 
সেনাবাহিনীর জয়গান গা এই অসময়ে!

দেশদ্রোহীলক্ষ কোটির ঋণখেলাপি ঘোর অনিয়ম, করে যাস চীৎকার !
চাষাদের ঋণ করবো মুকুব কেমনতরো বেয়াদব আবদার 
বুঝিস কিছু
অর্থনীতির জটিল তত্ব বুঝিস কিছু!

দেশদ্রোহী! দেশের খাবো পড়বো দেশের, তবু বিরোধীতা ঢিল তুলে নেবো হাতে!
সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দেয় ষড়যন্ত্রীর লাজহীন মদতে
করবো দমন
বিরুদ্ধবাদ চক্রান্ত করবো দমন!

দেশদ্রোহী! জনকল্যাণ কর্ম কোথায় এই নিয়ে তোরা করে যাস ঝুলোঝুলি!
খোলাখুলি বলি, এগুলো এখন বস্তাপচা সাংবিধানিক বুলি 
একটাই কাজ 
দেশপ্রেমভাব চাগিয়ে তোলার একটাই কাজ!

দেশদ্রোহী! সর্বধর্মসমন্বয়ের ধর্মকথা যতসব বুজরুকি!
আনুগত্যই মাপকাঠি তোর ভারতবাসী সাচ্চা নাকি মেকি
ধার্মিকতা
সহিষ্ণুতার বিপরীত নামই ধার্মিকতা

দেশপ্রেমিক! শতশহীদের রক্তে ভেজা সাহস রাঙা আত্মত্যাগের গাথা
ইতিহাস ভুলে মীরজাফরেরা নিয়েছে আজকে দেশপ্রেমের ঠিকা
হায় স্বাধীনতা 


পরাধীনতার সংকেত শুনি, হায় স্বাধীনতা!

Sunday, 13 August 2017

আপনঘর



ছাদের বিমটার পাস্ দিয়ে হালকা চিড় ধরেছে, নাইট ল্যাম্পের আলোতেও স্পষ্ট বুঝতে পারে সুজাতা জানলার পর্দাগুলোতেও কেমন হতশ্রী ছাপ ! ঘরের কোনাগুলোতেও হালকা ঝুলের আভাস দরজা জানলা গুলো বোধহয় খুব একটা খোলা হয়না, চারদিকে যা মশা ! এই বাড়িতে চিরকাল ই মশার উৎপাত বেশি এখন আর মশারি টাঙিয়ে শোওয়ার অভ্যাস চলে গেছে আজও যখন অগত্যা এই বাড়িতে থাকতেই হচ্ছে তখন মশারি আর টাঙায়নি সুজাতা, একটা মশা তাড়াবার মেশিন লাগিয়ে দিয়ে গেছে কেউ, তাতে ঘরে মশা নেই ঠিকই কিন্তু কেমন একটা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন বদ্ধ ঘরে থাকার অভ্যাস চলে গেছে একদম, ঘুমটা কি সেই কারণেই আসছেনা? বুঝতে পারেনা সুজাতা
শেষ কবে রাত কাটিয়েছে এই বাড়িতে? ভাবার চেষ্টা করে সুজাতা মনে পড়ে যায়, প্রায় চার বছর হলো চার বছর! চার বছর হলো মা নেই! পাশ ফিরে শুতেই আধো অন্ধকারে দেখতে পায় মা'কে ফটোফ্রেম এর মধ্যে থেকে মা হাসছে একটা প্লাস্টিকের মালা ঝুলানো ছবিতে চোখের কোন দিয়ে জলের স্রোত নেমে বালিশ ভিজে যায় এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলে মা আমাদের ছেড়ে?
বিয়ের পর এইবাড়িতে এলে এই ঘরেই মা আর মেয়ে শুতো রাতে খাওয়া দাওয়ার পাট মিটলে মায়ে ঝিয়ে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা হতো সংসারের টুকিটাকি গল্প, জামাই এর অফিসের চাপ, এই বাড়িতে টুকটুকির দুস্টুমি, টুকটুকিকে সামলাতে রিঙ্কির নাজেহাল অবস্থা, তাই নিয়ে মায়ের অনুযোগ.., দাদার আর রিঙ্কির ঝগড়া, বাবার বাজার করার বহর, মা কে ব্যতিব্যস্ত করা ফরমায়েশের চক্কর কি থাকতোনা সেই গল্পের সূচিপত্রে ! বিয়ের পরপর আর একটা প্রশ্ন, কিংবা জিজ্ঞাসা থাকতোই, তা হলো ঠারেঠোরে বোঝার চেষ্টা, শ্বাশুড়ি কি করেন, ননদের ব্যবহার কেমন, জামাই ঠিকঠাক খেয়াল রাখে কিনা, মায় জামাই ঠিকমতন আদর করেতো? এ যেন বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির মায়ের চিরকালীন জিজ্ঞাসা ! যেন সমস্ত তথ্য একত্র করে বুঝে নিতে চাওয়া যে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে তার জায়গা পাকা করে নিতে পারলোতো?
বিয়ের ঠিক পরপর খড়দহ আর সোদপুর এর মাঝে কোনো এক জায়গায় বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন ছিল সুজাতাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ে ছিল বলেই সুজাতা আর তন্ময়কে একসাথেই যেতে হয়েছিল বিয়ের কাজ শেষ করে সুজাতা দেখলো যে বাড়ি ফিরে যাওয়া অসম্ভব, এত রাত হয়ে গেছে, আবার শখ করে বিয়েতে পাওয়া নেকলেস টাও পড়ে এসেছে, তন্ময় ই বললো, এতো রাতে বাড়ি না ফিরে চলো তোমাদের বাড়িতে চলে যাই , বাড়ি তে মা কে বলে এসেছি যে আজ রাতে নাও ফিরতে পারি, কাল সকালে আমি এখান থেকে অফিসে চলে যাবো, তুমি পরে বাড়ি ফিরো নিজে সেটাই চাইছিলো, কিন্তু নিজে মুখে তন্ময়কে সেটা বলতে বাঁধছিলো , তন্ময় যখন নিজে থেকেই প্রস্তাবটা দিলো, যেন নেচে উঠলো সুজাতা এইবাড়িটা গলির মধ্যে, রিকশা ঢোকেনা ভালোমতো মেইন রাস্তায় রিকশা দাঁড় করিয়ে তন্ময় ভাড়া মেটাচ্ছিলো, সুজাতা দৌড়ে এসে বাড়ির গেট টায় আওয়াজ করলো, রাত প্রায় সাড়ে ১২টা, আস্তেই ডাকলো, "মা, মা?" ১০ সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলেছিলো মা, গেট এ মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যতনা আনন্দ তার চেয়ে হাজার গুন আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার ছবি মায়ের মুখে দেখেছিলো সুজাতা বুঝতে পেরেছিলো তন্ময়, রিকশা ভাড়া মিটিয়ে তখন ও প্রায় এসে গেছে গেট এর কাছে দূর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলো মা কে," মা, আমিও আছি এখানে " তন্ময়কে দেখে মায়ের মুখের সেই আতঙ্ক এক নিমেষে দূর হয়ে যে নিশ্চিন্তির প্রলেপে ঢেকে গেলো তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি ওর মা'রা কি চিরকালই এমন উৎকণ্ঠায় ভোগেন মেয়ে কে নিয়ে? কে জানে! সুজাতার তো মেয়ে নেই, ও হয়তো ওর মায়ের এই মনের কথা কোনোদিন বুঝতেও পারবেনা তবে এতদিন বাদে এই বাড়িতে থেকে একটার পর একটা স্মৃতি ভেসে আসছে
এইঘরেই তো শুতো মা আর মেয়েতে মিলে খুব ফুলের শখ ছিল সুজাতার নিজের হাতে ছাদে কতনা ফুলের চাষ করতো, বাইরে গলিটা দিয়ে কোনো মানুষ গেলেই তাকাতো উপরের দিকে, ঘাড় উঁচিয়ে দেখতো মাথা উঁচু করে থাকা রংবেরঙের পেল্লাই সাইজের ডালিয়া, থোকা থোকা চন্দ্রমল্লিকার শোভা অথবা অনেক কষ্টে ফোটানো গোলাপের বাহার সুজাতা আর রিঙ্কি এক ক্লাসে পড়তো, সেই বন্ধুত্ব যেন কোথায় একটা অন্যরকম হয়ে গেলো যেদিন সম্পর্ক টা ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে বৌদি তে রূপান্তরিত হয়ে গেলো সুজাতা কি মেনে নিয়েছিল এই সম্পর্ক ? কে জানে? রিঙ্কির প্রেমে পরে তাদেরই বন্ধু অর্ণব কেমন পাগলের মতন হয়ে গেছিলো তাতো জানে সুজাতা তাই দাদা যেদিন এই সম্পর্কের কথা জানালো তার আদরের বোনকে, সে যেন সব বুঝেও বুঝে উঠতে পারছিলোনা বাঁধা দেয়নি, কিন্তু কিছু একটা গলায় কাঁটা বেঁধার মতন অনুভূতিও হয়েছিল ওর তা ও জানে বিয়ের পর আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক ও হয়ে উঠেছিল হয়তো পরস্পরকে আগে থেকে চেনার কারণেই সম্পর্কটা ঠিক ননদ বৌদির ছিলোনা, হয়তো বন্ধু হবার সুবাদেই ওর আচরণ ও সবক্ষেত্রে ঠিকঠাক হতোনা, নিজের বিয়েও হয়নি, নিয়মিত পাত্রপক্ষের সামনে ইন্টারভিউ দিতে বসে কোথাও একটা হতাশা, ঈর্ষা কাজ করতো, আজ বোঝে সুজাতা বোঝে যে অবিবাহিত অবস্থায় থাকা একটা মেয়ের বিবাহিত মেয়েদের মানসিকতা, তাদের সমস্যা, তাদের চাহিদা কি হয়তো সবসময় বোঝা সম্ভবনা, সেও বোঝেনি, তা রিঙ্কি যতই তার বন্ধু হোক
একদিনের ঘটনা মনে পড়লো ভোরবেলা রিঙ্কি ঘুম থেকে ডেকে তুললো সুজাতাকে ঘুম থেকে কেউ ডেকে তুল্লে এমনিতেই মাথা গরম হয় সুজাতার, আর সেদিন যা রিঙ্কি করেছিল তাতে মাথায় আগুন ধরে গেছিলো ঘুম থেকে সুজাতাকে বিছানায় উঠিয়েই ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিলো একটা সদ্য ডালভাঙ্গা শিশিরভেজা গোলাপ এর কুঁড়ি সেই গোলাপের কুঁড়ি হাতে নিয়ে ঘুমভাঙা চোখে গর্জে উঠেছিল সুজাতা, "তুই আমার গোলাপ ভেঙেছিস? এত্ত কষ্টে গাছে সবে কুঁড়িগুলো ফোটাতে পেরেছি.....!"
রাগ এর আঁচে ও শুনতেই পায়নি রিঙ্কি বলেছে "হ্যাপি বার্থডে সুজা..." আজও মনে মনে লজ্জা পায় সুজাতা সেদিনের সেই কথা মনে পড়লে
আসবেস্টস দেওয়া ছাদ এর চিলেকোঠার ঘরে ছিল দাদার আস্তানা বন্ধুবান্ধব কেউ এলে সামনে যাবার অনুমতি ছিলোনা, এমনি রক্ষনশীল ছিলেন বাবা সেই বাবাকে দেখলে আজ কেমন অবাক লাগে মা চলে যাবার পর সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন, এমনকি যে বাজার নিয়ে মায়ের সাথে রোজ ঝগড়া, সেই বাজারেও আর যায় না বাবা, সবকিছু দাদাকে করতে হয় আর সেই ফুলটুসির মতন রিঙ্কি, কলেজের হার্টথ্রব, সে এখন এতটাই পৃথুলা হয়েছে যে ওদের বন্ধুরা অবধি ওকে দেখে চিনতে পারেনা, এই সেই রিঙ্কি! বছরের অর্ধেকদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় হাঁটু আর কোমরের ব্যথায় ইদানিং নাকি থাইরয়েডের সমস্যাও ধরা পড়েছে সুজাতাও কি ভালো আছে? পিরিয়ডের সমস্যাটা একটু একটু করে বাড়ছে রোজ, ডক্টর মুখার্জি সামনের মাসে লোয়ার অবডোমেন এর ইউএসজি করে নিয়ে যেতে বলেছেন এদিকে তন্ময়ের প্রমোশন হওয়ার পর থেকে একটা মুহূর্ত সময় পায়না, বান্টিটার মাধ্যমিক সামনের বছর, সংসার সামলাতে ওরওতো নাজেহাল অবস্থা মা চলে যাবার পর এই যে চার বছর কেটে গেলো কতদিন ও আসতে পেরেছে এই বাড়িতে? অথচ সোদপুর থেকে সন্তোষপুর কতটা দূরত্ব! তাও পারেনি পারেনি কি? নাকি ইচ্ছেও করেনি মা চলে গেলে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থাকেনা? কে জানে? যতদিন এসেছে দেখেছে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়া এক অশীতিপর বৃদ্ধকে,নিজের ঘরে একলা টিভি চালিয়ে হয়তো বসে আছেন, বহুদিনের কাজের মাসি নমিতাদি চা এর কাপ এনে সামনে রাখলেন, রিঙ্কি তার শরীরের কারণে তার দোতলার ঘর থেকে নীচে নামতে পারেনা, বিয়ের অনেক পরে বানানো দোতলার ঘরে সে হয়তো তখন টুবলুর পিছনে লেগে রয়েছে, টুবলুকে তার হোমওয়ার্ক এর জন্য তাগাদা দিচ্ছে, টুবলুও ছাড়বেনা, সে তার পিসিমনির কাছে বায়না জুড়েছে যে পার্ক এ ঘুরতে যাবে! সেই পুতুলের মতন টুকটুকি এখন লেডি! কি মিস্টি দেখতে হয়েছে ! সেওতো এই বছর হায়দ্রাবাদ চলে গেছে কিসব পড়তে যেন! বাড়িটাও কেমন খা খা করে!
ছাদের সেই ঘরটা নেই এখন ওটা টুবুলের পড়ার ঘরে পরিণত হয়েছে একদিন নমিতাদি না থাকায় দাদাদের ঘরে চা দিয়ে পাঠিয়েছিল মা চুপিচুপি, যেন বাবা না দেখতে পারে দরজায় ঢুকতে গিয়েই দুজনের কথোপকথনে পা থমকে দাঁড়িয়েছিল সুজাতা ও শুনলো অমিতদা দাদাকে বলছে, "শুভ, আমি একটা অপরাধবোধে ভুগছি, জানি এই চিন্তা আশা আমার উচিত না, তবুও তোকে না বলে পারছিনা "
--"কি হয়েছে বলে ফেল "
--" আমি সুজাতার প্রতি কেমন দুর্বলতা ফিল করছি "
দাদা অনেকক্ষন চুপ করে থেকে বললো, "সুজাতা? আর ও?"
--"না, না, সুজাতা কিছু জানেনা, এটা আমার একতরফা ফিলিং , তোকে না বললে অপরাধী লাগছিলো নিজেকে, তাই বললাম "
বাকিটুকু আর শোনেনি সুজাতা নিঃশব্দে নীচে চলে এসে মা কে বলেছিলো, "ওদের দরজা বন্ধ মা, আমি ডাকতে পারিনি, তুমি যাও"
কেউ ওকে ভালোবাসতে পারে, কারো চোখে সেও ভালোবাসার কেউ হতে পারে বুঝেছিলো সেইদিন প্রথম ভালো লেগেছিলো? আনন্দে ভেসে গেছিলো? বাবার কি প্রতিক্রিয়া হবে তা ভেবে কুঁকড়ে গেছিলো? আজ আর তা মনে করতে পারেনা সুজাতা তবে অমিতদা এইবাড়িতে আসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলো সেদিনের পর
অনেকদিন পর নিজের শহরে ঘুরলো সুজাতা, দাদার সাথে বাইকে বর্ষা হলেই এই নাটাগড় , এইচ বি এর রাস্তায় জল থৈ থৈ করতো, সুলেখা র মোর টা চিনতেই পারেনা এখন সুজাতা গোশালার মাঠকে পাশে ফেলেই তো স্কুলে যেতে হতো ওকে কিরকম সব পাল্টে গেছে ! এইমাঠেই শীত পড়লেই সার্কাসের দল তাবু ফেলতো মেলা, কত খুশি ! আজ ও চোখ বুজলে শ্রীনিকেতনের একতলা দোকানটা যেন চোখের সামনে ভাসে! আজ তার বিপরীতে পেল্লাই মাল্টিসোরেড শপিং কমপ্লেক্স, সুজাতা যদিও সোদপুরে এসে কেনাকাটা করেনা, ওরতো পা বাড়ালেই সাউথ সিটি, রোজকার নিত্যিদিনের টুকটাক কেনাকাটার জন্য গড়িয়াহাট, আর বাইপাসের ধরে বিগ বাজার আছেই ও কোন দুঃখে শ্রীনিকেতন আসবে কেনাকাটা করতে! তবুও পুজোর সময়ে মা বাবার হাত ধরে পুজোর জামা কিনতে যাবার সময়কার ছবিটা যেন স্মৃতিতে কেউ আটকে রেখে যায় এক্সিবিশন এ টাঙানো ছবির মতন যে ছবিতে সময়ের ব্যবধানে ধুলো পড়েনা, হয়তো একটু ম্লান হয়ে যায়, কিন্তু সেই ম্লান ছবিটাই যখন চোখের সামনে ফুটে ওঠে চোখটা কখন যেন ঝাপসা হয়ে ওঠে ক্ষনিকের জন্য
রিঙ্কি আর দাদার বিবাহবার্ষিকী সামনে কত তম এটা? ২২তম হবে বিকেলে দাদা ফিরতেই বললো. "চল দাদা একটু ঘুরে আসি, কতদিন নিজের শহরে ঘুরিনা, সবকিছু কেমন পাল্টে গেছে" রিঙ্কিকে ডেকে বললো, "যাবি রিঙ্কি? চল একটু বেরিয়ে আসি "
--"আমি পারবো না রে, একটু হাঁটলেই আমি হাঁফিয়ে যাই, তুই বরং তোর দাদাকে নিয়ে ঘুরে যায় "
মনে কোনো প্যাঁচ নিয়ে বলেনি রিঙ্কি, ও সত্যিই পারেনা এখন ওই চেহারা টাকে সামলে রাস্তায় বেরোতে, খুব কষ্ট হয় ওকে দেখলে, টুবলু হবার পর শরীরের সব ক্ষমতা যেন আরো হারিয়ে ফেলেছে, এখন বসে থাকলেও কেমন হাঁফায় মা চলে যাবার পর একটু হলেও তো সংসারের চাপ বেড়েছে, নমিতাদি আর কত করবে, তারওতো বয়স হচ্ছে ! মাঝে মাঝে সেই পুরোনো রিঙ্কির সাথে আজকের রিঙ্কিকে পাশাপাশি রেখে কল্পনা করে সুজাতা, খুব অবাক হয়, ভাবে আচ্ছা অর্ণব যদি আজকের রিঙ্কিকে দেখতো, পাগল হতে পারতো?
দাদাটাও কিরকম হয়ে গেছে! দাদা বরাবর হ্যান্ডসাম, লম্বা পুরুষালি চেহারা, ছোটবেলায় কত বান্ধবীর মুখে শুনেছে, সুজা'র দাদাকে একদম চিরঞ্জীত এর মতন দেখতে সাধে কি রিঙ্কি দাদাকে পছন্দ করেছিল? শুধুতো হ্যান্ডসাম, নয়, শুভব্রত রায় এর এই তল্লাটে নাম ছিল ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হিসাবে সেই দাদাই কত পাল্টে গেছে, মাথার চুলগুলোতে সাদা ছোপ, চোখে চশমা, লম্বা চেহারাটা কেমন ঝুঁকে গেছে যেন সবকিছু পাল্টে গেছে, নিজের দিকেও তাকিয়ে দেখে আজকাল এই অনুভূতি হয়, বুড়ি হয়ে যাচ্ছি?! কষ্ট হয় কেমন যেন, কিন্তু মুখে প্রকাশ করা যায়না!
--"দাদা, ঘোলার ওদিকে একটা আশ্রম ছিল মনে আছে? একজন সাধুবাবা ছিলেন, খুব ভক্তি আসতো ওঁকে দেখে, আছে এখনো ওই আশ্রমটা? সাধুবাবার বেঁচে থাকার কথা নয় যদিও"
--"জানি নারে, যাবি কি? চল তাহলে দেখে আসি"
--"না থাক, চল বিটি রোডের দিকে চল" কি ভেবে বলে উঠলো সুজাতা হয়তো ভাবলো ছোটবেলার সেই ভালোলাগার আশ্রমটাও যদি গিয়ে দেখে নেই, খুব কষ্ট পাবে, তার চেয়ে ভালো সত্যিটা না জানা
বিটি রোডের ধারের প্যান্টালুনস থেকে দাদাদের এনিভার্সারি গিফটস, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, টুবলুর জন্য একটা ভালো খেলনা গাড়ি, টুকটুকির জন্য একটা টপ কিনে বাড়ি ফিরলো দুই ভাইবোন
বিকেলে ঘুরে আসার পর বাবা সবাইকে ডাকলেন আলমারি খুলে একটা বাক্স নিয়ে আসলেন, বাক্সটাকে খাটের উপরে রেখে বললেন, "যে জন্য তোকে আজকে এতো জোর দিয়ে থাকতে বললাম বুবু, বাবিন আছে, বৌমা ও আছে, আমি চাই আমি বেঁচে থাকতে থাকতে তোদের মায়ের গয়নাগাটি কাপড়চোপড় যা আছে তা নিজে হাতে ভাগ করে দিতে যাতে আমার অবর্তমানে এগুলো নিয়ে কোনো অশান্তি নাহয় তোদের দুই ভাইবোনে "
রিঙ্কি বলে উঠলো, "বাবা, আপনি না ভাগ করলেও আমাদের মধ্যে এগুলো নিয়ে অশান্তি, ঝামেলা হতোনা "
--" জানি বৌমা, আমার ছেলে মেয়েদের সে শিক্ষা আমি দেইনি, আর তোমার উপরেও আমার সেই ভরসা আছে তবুও জানতো, অর্থ অনর্থের মূল? তাই এই প্রয়োজনীয় কাজটা আমি করে যেতে চাই তোমাদের মায়ের আলমারির চাবি দিয়ে দিচ্ছি, মায়ের যা আছে তোমরা দুই মেয়ে বৌতে ভাগ করে নাও "
কান্না আর কান্না! পার্থিব সম্পদ লাভ হচ্ছে, তাও চোখের জল বাঁধ মানেনা কেন ? কত পরিবারে তো শোনে যে সম্পত্তির ভাগ নিয়ে মারামারি, কাটাকাটি, মামলা মোকদ্দমা, মায় খুনোখুনি পর্যন্ত! এখানেতো সেসব কিছু নেই, পারলে কে কাকে কোনটা দিয়ে দেবে তার কম্পিটিশন চলে, যেন অধিকার ছেড়ে দিয়ে বোঝাতে চায় ,"আমার নিজের যা আছে তা যথেষ্ট রে, আর বেশি কিছু চাইনা " ভাগাভাগির পর্বটা রোমাঞ্চহীন বলেই কি মা কে আরো বেশি মনে পড়ছে ? মায়ের এক একটা গয়না খোলা হচ্ছে আর সুজাতার সামনে এক একটা দিনের গল্প যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঁকি মেরে যাচ্ছে, হৃদয়ের মধ্যে কান্নার বাঁধ ভাঙছে অথচ কাঁদা যাচ্ছেনা, বাবার কথা ভেবে দাদাও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে, সুজাতা জানে দাদাও হয়তো হেঁটে বেড়াচ্ছে ছেলেবেলা অথবা যৌবনবেলার স্মৃতির অলিগলিতে
বেশি গয়না মায়ের ছিলোনা, সেটা ভাগ হতেও সময় লাগলোনা, কাপড়গুলো ভাগ করার সময় সুজাতা বললো, "রিঙ্কি, তুই তো শাড়ি খুব একটা পরিসনা, আমায় শুধু মায়ের আটপৌরে শাড়িগুলো দে, ওগুলো আমি বাড়িতে পড়বো "
--"তা বললে হবে সুজা, ভালো শাড়িগুলোও নে", এই বলে নিজেই বেশ কয়েকটা শাড়ি সুজাতার জন্য আলাদা করলো কিছু শাড়ি নিয়ে বললো, "এগুলো বাবা নমিতাদি আর হাবুর মা কে দিয়ে দেই?"
যেন স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী চলছে সব নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে এক একটা জিনিস হাতে আসছে সুজাতার আর মনে হচ্ছে যেন একএকটা করে ডালপালা কেটে একটা গাছকে শীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে এইবার গাছটাকে মাটি থেকে উপড়ে ফেলা হবে বুকের কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আসতে থাকে সুজাতার
মোক্ষম কথাটা বললেন বাবা এরপরে
--" এই বাড়িতে তোমাদের দুই ভাইবোনের সমান অধিকার কিন্তু বুবু, তুই কোনোদিন এইবাড়িতে এসে থাকবি না, এই বাড়ি করার পিছনেও তোর দাদার অনেক কনট্রিবিউশন আছে তবুও তুই তন্ময়ের সাথে একবার কথা বল, ওর মতামত জানলে পর এই ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নেবো "
--" তুমি তো তোমার জামাইকে চেনো বাবা, এই বাড়ির বিষয়ে ওর কোনো বক্তব্য নেই, তার দরকার ও নেই, আমি বলছি এই বাড়ির ভাগ আমার চাইনা"
--"আমি সবকিছু আমার বুদ্ধিতে করছিনা বুবু, যা করছি তা তোর মায়ের ইচ্ছেতেই করছি " এইটুকু বলে পাশের ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা ব্যাঙ্কের চেক বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, "তুই ভাগ নিবিনা জানিরে, কিন্তু বাবা হিসাবে আমি কোনো পার্সিয়ালিটি করতে পারিনা এটা তুই রাখ, বাড়িটা আমি বাবিনের নামে দানপত্র করে দেব "
--"এটাও আমি তোমার জামাইয়ের সাথে কথা না বলে নিতে পারবোনা "
--"আমি তন্ময়ের সাথে কথা বলেছি আজকে বিকেলে এই বিষয়ে তোরা তো আমার সন্তান রে, আমি জানি আমার কাজকে তোরা সমর্থনই করবি "
--"সব হিসাব চুকিয়ে দিচ্ছ বাবা, এইবাড়ির সঙ্গে থেকে সুজাতা বসুর নামটা মুছে দিলে পুরোপুরিভাবে ?" মনে মনে এই কথা বললেও মুখ ফুটে বেরোলোনা তা, বাবা কষ্ট পাবে, দাদা কষ্ট পাবে!l
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ অনেকক্ষন একা এই খাটে শুয়ে থাকতে থাকতে কত কিছু মনে পরে সুজাতার এইবাড়িতে জন্ম, এই বাড়ির প্রতিটা আনাচেকানাচে কে চিনতো ও, আজ থেকে আর এই বাড়ির সাথে সুজাতার নাম জড়িয়ে থাকবেনা এই কষ্ট কি সব মেয়েরই হয় জীবনে? এই বাড়িতে আমি জন্মালাম, এইখানে বড় হলাম, এই বাড়ি এই মাটির সাথে মিশে থেকে আমি জীবনকে চিনলাম, আর একদিন হঠাৎ করে জানলাম এইখানে আমার আর নিজস্ব বলে কিচ্ছু নেই! বৌভাতের রাতে তন্ময়ের বলা একটা কথা মনে পড়লো সুজাতার
--"এখন থেকে এই বাড়ি তোমারও, তাই এর ভালোমন্দ, সম্মান বদনামের ভাগিদার ও তুমি" একটু থেমে তন্ময় আবার বললো, " আচ্ছা সুজাতা, এই যে বললাম, যে এই বাড়ি তোমারও, কিসের জোরে বললাম? জানো?"
এতকিছু বোঝেনা সুজাতা, শুধু বলেছিলো, "জানিনা আমি তোমার স্ত্রী বলে?"
হেসে উঠেছিল তন্ময়, "একদম ঠিক, কিন্তু জোরটা কিসের?" অনেকক্ষন থেমে বলেছিলো, " জোরটা আইনের যে মুহূর্তে তুমি মিসেস তন্ময় বসু হলে সেই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার যা আছে তার আইনি অংশীদার এই আইনি অধিকারটা হলো কাঠামো, এর উপরে ভালোবাসা , দায়, দায়িত্ব, কর্তব্য এগুলোর প্রলেপ দিয়ে সংসারের মূর্তি টা গড়তে হয় ভুলোনা এটা"
আজও ভোলেনি সুজাতা
সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হলো, আসলে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুম আসতেই দেরি হলো বিছানার পাশে রাখা মোবাইল এ দেখলো অনেকগুলো মিসড কল বান্টির , তন্ময়ের কি হলো এর মধ্যে! ৪ বার ফোন করার লোক তো তন্ময় নয় ! দুশ্চিন্তা নিয়েই ফোন করলো বান্টিকে
--"ও মা, কতবার ফোন করছি তুমি ধরছোই না, এদিকে জানো কি হয়েছে ? আজ সকালে রিনা মাসির ছেলে বাবাকে ফোন করে জানিয়েছে যে রিনামসির জ্বর, আসতে পারবেনা তুমি চিন্তা করোনা মা, মি এন্ড বাবা ম্যানেজড ইট ওয়েল. ঠাম্মিকে দুধ গরম করে দিয়েছি, উইথ কর্নফ্লেক্স বাবা আর আমি টোস্টারে টোস্ট বানিয়েছি, এখন বাবা চা করছে আর বলেছে যে অফিস যাবার আগে সুইগিতে লাঞ্চ অর্ডার করে দেবে তুমি একদম ভেবোনা আজ স্কুল যাবোনা, বাড়িতে ঠাম্মি একা থাকবে তো বিকেলে ম্যাথস এর টিউশন আছে কিন্তু তুমি কখন আসবে?"
--" ঠিক আছে ঠিক আছে, তোমরা বাপ্ ছেলে আমার রান্নাঘরের কি অবস্থা করবে তা আমার জানা আছে, দাও তোমার বাবাকে ফোন টা দাও"
--"দিচ্ছি দিচ্ছি, বাবা মায়ের ফোন"
--" এই শোনো, আমি একটু পরেই চলে আসছি, তোমার ওই সুইগি ফুইগিতে কিচ্ছু বলতে হবেনা, ঐসব খাবার মা খেতে পারবে? যা খুশি তাই করলেই হলো? আমি এসে যা করার করছি বুঝেছো? আর পারলে অফিস বেরোবার আগে লন্ড্রি থেকে জামাকাপড়গুলো এনে রেখো ঠিক আছে আমি রাখছি "
ফোনটা রেখেই চিৎকার করে বললো, "দাদা তোদের এখানেতো এখন ওলা উবের পাওয়া যায়, দেখনা একটা এভেইলেবেল কিনা আমি দশ মিনিটের মধ্যে বেরোবো এখন এই ব্যাগপত্র নিয়ে কিছুতেই ট্রেনে ওঠা যাবেনা "
রিঙ্কিও চিৎকার করে বললো, " সেকিরে, তোর জন্য ট্যাংরা মাছ আনলো তোর দাদা, এতো ভালোবাসিস তুই, আর তুই বলছিস চলে যাচ্ছিস?"
বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে কোনোক্রমে সুজাতা বোঝালো যে কেন ওর যাওয়াটা জরুরি
গলির মুখে দাঁড়ানো ওলার সুইফট ডিজায়ার এ ব্যাগপত্র তুলে দিলো শুভ বাড়ির গেট এ দাঁড়িয়ে বাবা, নমিতাদি। রিঙ্কি তার ভারী শরীর নিয়ে দোতলার বারান্দায়, টুবলুটা বোধহয় স্কুলে, ও শুধু নেই বাড়ির গেট থেকে বেরোলো সুজাতা সবাইকে আবার হাত নাড়লো
কাল যেসব কিছু ভেবে চোখের জল ফেলেছিলো রাতভর তার আর বিন্দুমাত্র কিছু ওর মনে নেই, ওর মন ছুটে গেছে নিজের বাড়ির দিকে, গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললো, "যাদবপুর সন্তোষপুর, যেদিক দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে সেইদিক দিয়ে চলো "


*****


সমাপ্ত

প্রতীক্ষা

শীতটা বোধ হয় এবার তাড়াতাড়িই পড়বে। সবে তো মাত্র ডিসেম্বর মাসের ক ’ টা দিন হয়েছে, পশ্চিমের সূর্যের তেজ যেন বিকেল হবার আগেই কেমন ম্লান ...